সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলৌকিক--(১ম পর্ব)"-------- মধু'র ভূবণ ।

SHARE:

bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প 

                       "অলৌকিক" (১ম--পর্ব)


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলৌকিক--১ম পর্ব"-------- মধু'র ভূবণ ।






একদিন দিব্য স্নান শেষ করার আগেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দরজা খুলে। নিজের শোওয়ার ঘরে না গিয়ে সে টানা বারান্দা পেরিয়ে নামতে শুরু করে দিল সিঁড়ি দিয়ে। তারপর সদর দরজা পার হয়ে চলে এসেছিল রাস্তায়। তখনও তার কিছু খেয়াল হয়নি।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ছোট রাস্তা, একটু পরে বাঁ-দিকে বেঁকে আর-একটা রাস্তা, তারপর এক মিনিট গেলে ট্রাম লাইন। দিব্য ছোট রাস্তাটা পেরিয়ে দ্বিতীয় রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে, তখন তার চোখ পড়ল চন্দনের দিকে। চন্দনকে যেন ভূতে থাপ্পড় মেরেছে, তার মুখখানা এমনই বিহ্বল। চন্দন চোখের পাতা ফেলতে পারছে না।

চন্দনের চোখে দিয়েই যেন দিব্য নিজেকে দেখতে পেল। সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার গায়ে সাবানের ফেনা।

জামা-কাপড় না থাকলে বোধহয় মানুষ নিজের শরীরটাকে খুব ছোট্ট মনে করে। নইলে দিব্য কেন ভাবল আড়াআড়িভাবে দুটো হাত চাপা দিলেই সে তার নগ্নতা লুকোতে পারবে?

চন্দন কিছু বলবার আগেই দিব্য পেছন ফিরে ছুটল! বাড়িতে গিয়ে সিঁড়ির প্রথম ধাপে আছাড় খেয়ে তার থুতনি ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল! এই সব কিছুই পাগলের মতন।

দিব্যকে যদি কেউ-কেউ পাগল ভাবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ওই অবস্থায় শুধু তো চন্দন তাকে একা দেখেনি, অনেকেই দেখেছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ির বারান্দায়, মোড়ের। দোকানপাট থেকে। মানুষ তার গৌরবের সময় প্রায়ই নিঃসঙ্গ থাকে। কিন্তু অপমানের মুহূর্তে সাক্ষীর অভাব হয় না।

চন্দন অবশ্য পরে এ বিষয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করেনি। পাড়ার কেউই কিছু বলেনি। দিব্যর বয়েস আটত্রিশ, সে প্যান্টের ভেতর সার্ট গুঁজে, মোজা ও শু পরে অফিস যায়। পাড়ার সবাই তাকে একই সঙ্গে উদার ও বুদ্ধিমান বলে জানে, তাই কিঞ্চিৎ সমীহ করে।

দিব্য নিজেই পরে অনেক ভেবেও বুঝতে পারেনি যে সেদিন সে কেন ওই অবস্থায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে গিয়েছিল। হঠাৎ কি তার মনে পড়ে গিয়েছিল কোনও জরুরি কাজের কথা? কী সেই জরুরি কাজ?

বাথরুমে মানুষ নগ্ন থাকে, অন্যমনস্ক থাকে, নিজের চরিত্রটা বদলে ফেলে, বয়েসের খেয়াল। থাকে না এই সবই ঠিক, কিন্তু কোমরের নীচে কিছু না জড়িয়ে কেউ তো বাইরে বেরোয় না। ভুল মনা অধ্যাপকদের সম্পর্কে অনেক গল্প শোনা যায়, কিন্তু দিব্য তো সেরকমও নয়। দিব্য বেশ মেপে-টেপে কথা বলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে।

অনেকদিন আগে অবশ্য আর একবার এরকম হয়েছিল, সেটা কাশীতে। দিব্যর বয়েস তখন এখনকার অর্ধেক। কী কারণে যেন সেবার কাশীতে দেড়-দু-মাস থাকা হয়েছিল, মাসি-পিসিদের সঙ্গে সাময়িক যৌথ পরিবারের অছিলায়। টুনু ও পিনাকীর সঙ্গে দিব্য গঙ্গায় সাঁতার কাটতে নেমেছিল।

দিব্য সাঁতার জানে, পিনাকীই ছিল খানিকটা দুর্বল, তাকে সামলাচ্ছিল অন্য দুজন। হঠাৎ এক সময় দিব্য ওপরে উঠে এল। সুইমিংট্রাঙ্ক নয়, জাঙ্গিয়া পরে নেমেছিল, সেটা যে শুধু পরা নেই তা নয়, সে সম্পর্কে তার কোনও সই নেই। জাঙ্গিয়া আপনা আপনি খুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক নয়, দিব্য কি ইচ্ছে করে খুলে ফেলেছিল? তার মনে নেই।

কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে সবসময় হাজার লোকের ভিড়। পাগল ভিখিরি ও সন্ন্যাসীর সংখ্যাও যথেষ্ট। দিব্যকে ওই অবস্থায় উঠে আসতে দেখে কেউ হইহই করে ওঠেনি, কেউ কোনও মন্তব্য করেনি।

ওদের স্নেহ মাসি আর রথীন মেসো বসে ছিলেন একটু দূরে জামা-কাপড় সামলাবার জন্য। আর ছিল দু-তিনটে কাচ্চা-বাচ্চা পিসতুতো-মাসতুতো ভাই বোন। রথীন মেসো হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন, কাচ্চা-বাচ্চারা হাততালি দিয়েছিল আর স্নেহ মাসিও হাসতে-হাসতে একটা তোয়ালে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, এই পাগল, তুই সোজা উঠে এলি, অ্যাঁ?

রথীন মেসোর হাসির চেয়েও স্নেহ মাসির অত হালকা সুরে কথা বলাটাই দিব্যর স্মৃতিতে গেঁথে। আছে। তখন দিব্যর উনিশ-কুড়ি বছর বয়েস, সে একটি পূর্ণাঙ্গ যুবক, তাকে ওই অবস্থায় দেখেও স্নেহ মাসি দিব্যকে একটি শিশুর মতন গ্রহণ করেছিলেন কী করে? পরে অনেকবার স্নেহমাসি হাসতে-হাসতে পারিবারিক মজলিসে ওই গল্প বলেছেন, জানো সেজদি, দিব্যটা এমন পাগল, ওই রকমভাবে যে উঠে এসেছে, তা খেয়ালই নেই। আমি তোয়ালেটা ছুঁড়ে দিলুম, তা দিয়ে প্রথমে মাথা মুছতে লাগল!

দিব্যর মা অবশ্য বরাবরই এ গল্পটা অবিশ্বাস করেছেন। একমাত্র মেয়েরাই বোধহয় প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের নগ্নতা মেনে নিতে পারেন না।

কেন কাশীর গঙ্গা থেকে দিব্য ওইরকমভাবে হঠাৎ উঠে এসেছিল তা সে আজও মনে করতে পারে না। সে তার চৈতন্যের গভীরতম দেশ পর্যন্ত খুঁজে দেখতে রাজি আছে এর উত্তর পাওয়ার জন্য। কিন্তু খানিকটা ডুব দিয়েই সে অন্য চিন্তায় হারিয়ে যায়।

আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল, সেটা অবশ্য নগ্নতার কিছু নয়। মাত্র দেড় বছর আগেকার কথা। সেদিন দিব্য খানিকটা মদ্য পান করেছিল, আড়াই-তিন পেগের মতন। দিব্য অত্যন্ত সেয়ানা মাতাল। যাদের মধ্যে ভদ্রতাবোধ অতি প্রবল তারা সহজে মাতাল হয় না। অফিসের পার্টিতে কিংবা বন্ধুমহলে দিব্যর এইরকম একটা বিভ্রান্তিকর খ্যাতি আছে যে ছ-সাত পেগ হুইস্কি খেলেও দিব্যর পা টলে না, জিভ জড়ায় না। এমন কি একবার বোম্বাই গিয়ে হোটেলে পার্টির হই-চই তে সাত পেগ মদ খাওয়ার পর জেনারেল ম্যানেজারের অনুরোধে দিব্য একটা জরুরি চিঠি ড্রাফট করেছিল, তার হাতের লেখা একটুও বদলায়নি, ভাবের প্রেসেন্টটেন্স থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারে সে একবারও এস দিতে ভুল করেনি। অফিসে দিব্যর এই চিঠি লেখার গল্প কিংবদন্তি হয়ে আছে।

সেই দিব্য এয়ারপোর্ট হোটেলের অফিসের পার্টিতে থেকে মাত্র আড়াই তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে হঠাৎ কারুকে কিছু না বলে বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরেছিল। সোজা যোধপুর পার্ক। কম দূর তো নয়। এর মধ্যে দিব্য একটুও ঘুমিয়ে পড়েনি, ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও নির্দেশ দিতে একবারও ভুল করেনি। যোধপুর পার্কের রাস্তাগুলো খুব গোলমেলে, বিশেষত গভীর রাত্রে। দিব্য তবু ঠিক বাড়ির সামনেই এসে উপস্থিত হয়েছিল।

দোতলা বাড়ি সামনে খুবই সামান্য, ক্ষমাপ্রার্থীর মতন এক চিলতে বাগান। হাফ গেট অনায়াসেই খোলা যায়, এইসব বাড়িতে হিংস্র কুকুর থাকা খুব স্বাভাবিক। দিব্য সেসব গ্রাহ্যই করেনি। একতলার দরজা কেন খোলা ছিল কে জানে, দিব্য সটান উঠে গিয়েছিল দোতলায়। তারপর বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কলিংবেলের বোতামে ডান হাতের তর্জনী চেপে ধরেছিল।

এ-বাড়িতে দিব্য আগে কখনও আসেনি, দূর থেকে দু-একবার দেখেছে মাত্র। দিব্য কি জানতো ডঃ খান্ডেলকর সে রাত্রে বাড়িতে থাকবেন না? দিব্য পরে বহুবার এ তথ্য অস্বীকার করেছে। ডঃ খান্ডেলকর কখন কোথায় যান তা দিব্যর জানবার কথা নয়। দিব্য আর ডঃ খান্ডেলকরের গ্রহ আলাদা।

একটানা কলিং বেল বাজার পর দরজা খুললেন মিসেস খান্ডেলকর। গলা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলা একটা সাদা রঙের রাত-পোষাক পরা। মাথার সব চুল খোলা, ক্রিম মাখা মুখখানা। চকচকে। এমন পোষাকে, এমন প্রসাধনে দিব্য ওই মিসেস খান্ডেলকর নাম্নী রমণীকে আগে। কখনও দেখেনি। আসলে সে ওঁকে এর আগে দেখেছেই মাত্র তিনবার, নিছক সৌজন্য—আলাপ, বাংলায় কথাবার্তা হলেও আপনি ছেড়ে তুমিতে নামেনি। দরজা খোলার পর সেই শ্বেতবসনা রমণীকে দেখে দিব্য বলেছিল, কেমন আছ, মহাশ্বেতা?

মিসেস খান্ডেলকর বাঙালি হলেও তাঁর নাম মহাশ্বেতা নয়। কুমারী জীবনে তাঁর নাম ছিল অনসূয়া রায়।

প্রগাঢ় বিস্ময়ে তিনি কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলেন না।

দিব্য ফট করে দশটা জানালা খোলার মতন অনেকখানি হেসে বলেছিল, তুমি ভালো আছো তো, সেই খবরটা নিতে এলাম?

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর বললেন, হোয়াট হ্যাপন্ড টুইউ? আর ইউ…অর আই…ইন…ইজ সাম ট্রাবল? আর ইউ লস্ট?

দিব্য বলল, নো, নো, নো, নাথিং হ্যাপন্ড টু মি, আই ওয়াজ জাস্ট পাসিং গ্রু। ভাবলুম, তোমার খবরটা একবার নিয়ে যাই।

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর এবার বাংলায় বললেন, কিন্তু, এত রাত্তিরে আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন, আপনার বাড়ি তো মানিকতলায়!

মানিকতলা যেন একটা দুর্বোধ্য শব্দ, এই ভাবে দিব্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শ্রীমতী খান্ডেলকরের দিকে। কোনও উত্তর দিল না।

আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে?

মহাশ্বেতা, তুমি ভালো আছ?

আপনি মহাশ্বেতা কাকে বলছেন? আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। ভুল জায়গায় এসেছেন।

কিছু ভুল হয়নি। তুমি নিজেকে চেনো না? তুমি কাদম্বরীর একটা চরিত্র, মনে নেই? তুমি কেমন আছো আজ?

আপনি বাড়ি যান!

না, আমি আজ এখানেই থাকব, তোমার সঙ্গে সারারাত গল্প করব।

প্লিজ, একথা বলবেন না। আপনার সঙ্গে যদি গাড়ি না থাকে, আমার চিন্তা হচ্ছে আপনি কী করে। ফিরবেন, কিন্তু…এখানে থাকা সম্ভব নয়, আপনি একটু বুঝবার চেষ্টা করুন…

শ্ৰীমতী খান্ডেলকর যদি তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতেন তাহলে দিব্য নিশ্চয়ই সেই দরজায় আবার দুমদুম করে ধাক্কা দিত। উনি যদি রূঢ় ব্যবহার করতেন, দিব্য চেষ্টা করত জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়তে। কিন্তু উনি দরজা খোলা রেখে মুখে এমন একটা বেদনার্ত দাবির ভাষা ফোঁটালেন যে দিব্য তখুনি মরমে মরে গেল। কোনওরকম বিদায় না জানিয়েই সে ছুট দিয়েছিল নীচের দিকে।

ট্যাক্সিটা দিব্যর জন্য অপেক্ষা করে ছিল না, সে থাকতেও বলেনি। দিব্য সে ব্যাপারে চিন্তাই করল না, সে আঁকাবাঁকা পায়ে হাঁটতে লাগল।

একটা কথাই শুধু ঘুরছিল তার মাথায়। খান্ডেলকরের বাড়িতে অন্তত দু-তিনজন দাস-দাসী থাকবেই। এত রাত্রে বেল দেওয়ার পর অনসূয়া, না, না, মহাশ্বেতা নিজেই কেন দরজা খুলে দিল? সে কি কারুর জন্য প্রতীক্ষা করছিল উঁহু, এরকম হতেই পারে না। তবে?

রাত একেবারে নিঝঝুম। এখন লোডশেডিং আছে কি নেই তা বোঝবারও উপায় নেই। দিব্য কোনদিকে হাঁটছে সে জানে না।

খানিক পরে তিন-চারটে ভুতুড়ে চরিত্র তাকে ঘিরে ফেলল। তাদের দাবি অনুযায়ী সে খুলে দিল হাতঘড়ি, পকেট থেকে পার্স। দিব্যর ঠোঁটে ফুরফুরে হাসি, সে যেন এসব ব্যাপারে বেশ মজা পাচ্ছে। ছায়ামূর্তির দিব্যর পার্সটা খুলে অসুখী ভাবে গজরাতে শুরু করতেই দিব্য বলেছিল, ওতে কিছু হল না? আমার হাওয়াই শার্টটা নেবে? প্যান্ট নেবে? খুলে দিচ্ছি!

একজন নিশাচর এগিয়ে এসে দিব্যর গালে জোরে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, হারামির বাচ্চা, মাল খেয়ে আমাদের সঙ্গে মজাক করতে এসেছিস? যা, বাড়ি যা!

ওরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরেও দিব্য একা ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফিক-ফিক করে হাসতে লাগল।

এসব কোনও কিছুই দিব্যর চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। তার ঘনিষ্ঠ মানুষজনেরা বলবে, অসম্ভব, অবিশ্বাস্য!

দুই

নামের পরিচয়ে মহারাষ্ট্রের মানুষ হলেও দু-পুরুষ ধরে খান্ডেলকরেরা কলকাতায় প্রবাসী। অজয় খান্ডেলকরের দুই দাদাই উচ্চ পদস্থ ব্যাঙ্ক কর্মচারী, অজয় নিজে একজন অর্থনীতির পণ্ডিত। ওঁর। বোন একটি বাংলা সংবাদপত্র সম্পাদকের স্ত্রী।

অজয় খান্ডেলকর দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট হয়েছিলেন, ইংরেজি ও বাংলায় সেবারে পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ নম্বর।

তারপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপগুলো অবহেলায় মেডেল তুলতে-তুলতে পেরিয়ে গিয়ে তিনি চলে গেলেন আমেরিকা। সেখান থেকে তিন বছর বাদে দেশে বেড়াতে এসে তিনি বম্বে-পুনে ঘুরে ট্রেনে এলেন হাওড়ায়। তারপর কলকাতা শহরে না ঢুকে পরবর্তী ট্রেনে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে।

অনসূয়ার সঙ্গে এর আগে কলকাতায় তাঁর দুবার মাত্র দেখা হয়েছিল। সৌজন্য মূলক আলাপ পরিচয় হয়েছিল, তার বেশি কিছু নয়। অজয় খান্ডেলকরের আশঙ্কা ছিল অনসূয়া তাঁকে চিনতে পারবে কি না।

অজয় খান্ডেলকরের চেহারায় বৈশিষ্ট্য আছে, একবার দেখলে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রায় সাহেবদের মতন ফরসা রং, মেদহীন লম্বা শরীর, লম্বাটে মুখ, তীক্ষ্ণনাক, অত্যন্ত গাঢ় ভুরু। সম্ভবত ওই ভুরুর জন্যই তার চোখ দুটি বেশি উজ্জ্বল দেখায়। তাঁর বাংলা উচ্চারণে সামান্যতম আড়ষ্টতা নেই।

পূর্বপল্লীর গেস্টহাউসের প্রায় উলটোদিকেই অনসূয়াদের বাড়ি। হঠাৎ দেখা হওয়ায় অনসূয়া বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল!

আপনি? আমেরিকা চলে গিয়েছিলে কেন? কবে ফিরলেন?

ফিরিনি এখনও।

শান্তিনিকেতনে আপনার কোনও লেকচার আছে বুঝি?

একটুও দ্বিধা না করে সহাস্য মুখে অজয় খান্ডেলকর বলেছিলেন, না, আমি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্য এসেছি।

এরকম কথা অনেকেই বলে। অনসূয়া এটাকে হালকা রসিকতা হিসাবেই নিয়েছিল। তাদের বাড়িতে ডেকে এনে অজয় খান্ডেলকরকে সে চা খাওয়াল পরিচয় করিয়ে দিল বাবা-মায়ের সঙ্গে।

অজয় খান্ডেলকর স্কুলে পড়বার সময় একবার শান্তিনিকেতন এসেছিলেন বটে কিন্তু ভালো করে তাঁর দেখা হয়নি সেবার। অনসূয়াই হল তাঁর গাইড। এক সাইকেলরিক্সায় ঘুরতে লাগল দুজনে।

অনসূয়ার ডাক-নাম হাসি, শান্তিনিকেতনে ডাক-নামটাই বেশি চলে। রবীন্দ্রনাথের আমলে এখানে যে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া ছিল তা এখনও মুছে যায়নি। রবীন্দ্রভবনের সামনে একজন বৃদ্ধ সুইডিস অনসূয়াকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, হাসি, শোনো, তোমার সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় কথা আছে।

সাইকেলরিক্সা থেকে নেমে অনসূয়া গেল সেই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে, অজয় খান্ডেলকর চুপ করে বসে রইলেন। মনে হল যেন তিনি তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময়টুকু পেয়েই তিনি একটা জটিল অঙ্কের সমাধান খুঁজছেন।

মিনিট পাঁচেক পর অনসূয়া ফিরে আসতেই তিনি হালকা গলায় বললেন, এখানে সবাই আপনাকে হাসি বলে ডাকছে, আমিও সেই নামে ডাকতে পারি!

স্বচ্ছন্দে! আমার আসল নামটা আমার নিজেরই তেমন পছন্দ নয়।

কে রেখেছিল ওই নাম?

আমার জ্যাঠামশাই, তিনি এখানে সংস্কৃত পড়াতেন। জ্যাঠতুতো দিদির নাম শকুন্তলা।

এখন বাঙালি মেয়েদের তিন অক্ষরে নামটাই ফ্যাসান তাই না?

না দু-অক্ষরের।

তারপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, শ্রীনিকেতন ঘুরে আসবার পথে হঠাৎ অজয় খান্ডেলকর এক জায়গায় সাইকেলরিক্সা থামাতে বললেন।

একটা জলাশয়ের পাশে বড় আমগাছতলায় দাঁড়ালেন দুজনে। একটুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর অজয় খান্ডেলকর বললেন, আমি চোদ্দ হাজার মাইল দূর থেকে আপনাকে একটা কথা বলার জন্যই এখানে এসেছি। ওখানে বসে আমি আপনার কথা অনেক চিন্তা করেছি। কথাটা ঠিক। কীভাবে বলতে হয় আমি জানি না, যদি কিছু ভুল হয় আপনি অপমানিত বোধ করবেন না। হাসি, আপনাকে আমি আমার স্ত্রী হিসেবে পেতে চাই।

পুরুষদের প্রণয় নিবেদন শোনার পূর্বী-অভিজ্ঞতা ছিল অনসূয়ার, তবু তার কানের ডগায় উষ্ণতা এসেছিল, মুখ রক্তিম হয়েছিল।

যাঃ, এসব কী কথা বলছেন।

না, না, না, আপনাকে এক্ষুণি কিছু উত্তর দিতে হবে না। আপনি ভালো করে চিন্তা করে দেখুন।

আপনার সঙ্গে আমার মাত্র কয়েকদিনের আলাপ।

তাতে কিছু যায় আসে না! এলগিন রোডে ডঃ মৈত্রর বাড়িতে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মনে আছে? আপনি গান গেয়েছিলেন দুটো, সে গানের লাইনও আমি বলে দিতে পারি। শুনুন, আমি মিথ্যে কথা বলছি না, আমেরিকায় বসে আমি আপনার কথা অনেক ভেবেছি, তারপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আপনি সময় নিন। আমি দু-সপ্তাহ। কলকাতায় থাকব, তারপর আর এক সপ্তাহ পুনেতে। তার মধ্যে আপনি জানাবেন। যদি রাজি না হন তাও জানাবেন। কিংবা যদি এক বছর, দুবছর অপেক্ষা করতে হয়, তাতে আমি রাজি।

আপনি কেন এইসব কথা বলছেন? আমি একটা অতি সাধারণ মেয়ে।

আমার চোখে আপনি অপ্রতিম!

এরপর ফেরার পথে দুজনে আর একটাও কথা হল না।

এক রিক্সায় দুজনে বসায় অঙ্গস্পর্শ হয়েছিল বটে কিন্তু অজয় খান্ডেলকর একবারও হাসির হাত ধরার চেষ্টা করেননি। তাঁর সমবোধ ও শিষ্টাচার নিখুঁত।

পরদিন হাসিকে কলকাতা ও পুনের দুটি ঠিকানা দিয়ে অজয় খান্ডেলকর ফিরে গেলেন।

তারপর কয়েকটি দিন হাসির মানসিক জগতে একটা প্রবল আলোড়ন চলল। একটা ঝড়ের মধ্যে সে যেন দিশেহারা, অথচ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীদের কাছেও সে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে পারে না।

হাসি তখন সঙ্গীত ভবনের নাম করা ছাত্রী। রেডিওতে একবার অডিশান দিয়েই পাশ করেছে। কলকাতায় এক বড় অনুষ্ঠানে শ্যামা নৃত্যনাট্যে শেষ মুহূর্তে প্রধানা গায়িকা এসে পৌঁছতে না পারায় হাসিই শ্যামার চরিত্রের সবকটি গান গেয়ে খুব সুখ্যাতি পেয়েছিল কাগজে-কাগজে। অনেকের আশা হয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে অনেকদিন পর আর একজন প্রতিভাবান রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা উঠে আসছে।

শুধু গান গাইতে জানলে, ছবি আঁকা শিখলে বা লেখার ক্ষমতা থাকলেই হয় না, শিল্পী হওয়ার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা দরকার। হাসির তা ছিল। হালকা আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতন মেয়ে সে নয়। নিশ্চিন্ত সুখী জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না, সে চেয়েছিল নিজের যোগ্যতার দাবি অর্জন করতে।

কিন্তু অজয় খান্ডেলকর সব গোলমাল করে দিল।

হাসি মনে-মনে হাজার বার বলতে লাগল, না, না, না, আমি এখন বিয়ে করব না, কিছুতেই বিয়ে করব না।

কিন্তু হাসিকে এই কথা বারবার বলতে হচ্ছেই বা কেন? অজয় খান্ডেলকর তো জোর করেননি, এমনকি হাসির বাবা-মাকেও কিছু জানাননি। মাঠের মধ্যে আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে অতি সংক্ষেপে একটি প্রস্তাব দিয়ে গেছেন মাত্র। তারপর দূরে সরে গেছেন। এখন হাসি তো তাঁকে কোনও উত্তর না দিলেই পারে। এসব ক্ষেত্রে নীরবতাই প্রত্যাখ্যান।

অজয় খান্ডেলকরের কলকাতা বাসের দুটি সপ্তাহ কেটে গেল। হাসি চিঠি লেখেনি বটে, কিন্তু প্রতিটি দিন সে গুনেছে। এবারে অজয় যাচ্ছেন পুনেতে। সেখানে আর মাত্র সাতদিন।

শুধু সুপুরুষ আর গুণবানই নয়, অজয়ের চরিত্র ও ব্যবহারে এমন একটা কিছু ছিল যা হাসিকে চুম্বকের মতন টেনেছে। এরই নাম কি প্রেম? কেন সর্বক্ষণ হাসি ওই মানুষটির কথাই ভাবছে? চোদ্দ হাজার মাইল দূর থেকে একজন মানুষ এখানে এসেছিল শুধু হাসির সঙ্গে দেখার করার জন্য!

পুনে থেকে একটা টেলিগ্রাম এল হাসির নামে। হাসি তখন বাড়ি ছিল না, তার বাবা সেটি সই করে নিয়েছিলেন, কিন্তু খোলেননি।

হাসি বাড়ি ফেরার পর তিনি জিগ্যেস করলেন, পুনেতে তোর কোন বন্ধু আছে রে?

হাসির সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। হাসি তার মুখের ভাব লুকোতে পারে না। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে কেন? বাবার সামনেই টেলিগ্রামটা সে খুলল।

অজয় জানিয়েছে, আমার ফ্লাইট পরশুদিন রাত্রে! আমি কি কিছুই না জেনে ফিরে যাব?

বাবা জিগ্যেস করলেন, কে?

হাসি কিছুই উত্তর না দিয়ে ছুটে গেল বাড়ি থেকে। এবারে একবার তাকে তপনের কাছে যেতেই হবে। বাবা-মাও বন্ধুর মতন, কিন্তু এক্ষুনি সে বাবা-মাকে কিছু খুলে বলতে পারবে না।

সব পুরুষ মানুষই প্রেমিক হওয়ার যোগ্য হয় না। তপন সেইরকম একজন। সে হাসির যত না। বন্ধু, তার চেয়ে বেশি ভক্ত। হাসি যে মাটি দিয়ে হেঁটে যায়, কেউ যদি বলে তপন ওই মাটি জিভ দিয়ে চাটো তো, তপন তা পারবে। কিন্তু তপন কোনওদিন বলতে পারবে না, হাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার হও।

লাইব্রেরি থেকে তপনকে হাসি টেনে আনল। দুজনে চলে গেল রেল লাইনের ধারে। তারপর তপনকে সব খুলে বলল।

তপনের একমাত্র চিন্তা হাসি যেন কিছুতেই কষ্ট না পায়। হাসির মুখ ম্লান হলে তপনেরও মুখ ম্লান হয়ে যায়।

কী হয়েছে হাসি?

হাসি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সে একটা কথাও বলতে পারছে না।

তপন চুপ করে চেয়ে রইল হাসির মুখের দিকে। তার বুকটা মুচড়ে উঠছে। কীসের যেন একটা সম্ভাবনা হঠাৎ কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাকে।

একটু পরে, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে হাসি বলল, তপন, আমি জানতুম না রে আমার মনটা এত দুর্বল! আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছি না।

আমাকে তুই সব খুলে বল!

আমাকে একজন ডাকছে, আমি যেতে চাই না, তবু আমাকে যেতেই হবে!

কে ডাকছে?

কদিন আগে একটি মারাঠি ছেলে এসেছিল, তুই দেখেছিলি? যাকে নিয়ে আমি সাইকেল রিক্সায় ঘুরছিলাম।

হ্যাঁ দেখেছি। ভালো নাচেন বোধহয় তাই নয়? চেহারা দেখে তাই মনে হয়।

ধুৎ! নাচ-গান কিছু জানেনা। অঙ্কের পণ্ডিত! আমেরিকায় থাকে, বুঝলি? আমার সঙ্গে কলকাতায় সামান্য একটু আলাপ হয়েছিল, আমার গান শুনেছিল। কোনওদিন আমাকে চিঠি লেখেনি, কিছু না! আমেরিকাতে বসে নাকি শুধু আমার কথাই ভেবেছে, সেখান থেকে এই যে সেদিন এল, আমার সঙ্গেই দেখা করার জন্য! তুই এটা বিশ্বাস করতে পারিস?

না।

কেন তুই তাকে অবিশ্বাস করবি। তুই তার সঙ্গে একটু কথা বললেই বুঝতে পারতিস সে মিথ্যে কথা বলার মানুষ নয়।

সে তোকে নিয়ে যেতে চায়?

হ্যাঁ।

কোথায়? বোম্বেতে?

কী জানি কোথায়?

তুই কি পাগল হয়ে গেছিস হাসি? ওরকম চোখের ভালোলাগা তো অনেকেরই লাগে। এখানে কতজন তোকে–।

তপন আমি সত্যি পাগল হয়ে গেছি রে! ও সেই যে শান্তিনিকেতন থেকে চলে গেল, তারপর প্রত্যেকদিন, জেগে থাকার সবটা সময় আমি শুধু ওর কথাই ভাবছি। এ যেন একটা চুম্বক, আমাকে অনবরত টানছে! আমি কিছুতেই নিজের মনটা ফেরাতে পারছি না অন্যদিকে।

তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?

না-না-না, আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কিছুতেই যাব না। আমি গান ছাড়তে পারব না, আমি তোকে ছাড়তে পারব না! আমি শুধু ওকে আর একবার দেখতে চাই! এরপর তপনের হাত দিয়েই একটা টেলিগ্রাম পাঠাল হাসি। অজয়কে লিখল, বিদেশে ফেরার আগে আপনি আর একবার শান্তিনিকেতনে আসতে পারেন?

দু-দিন পরে আবার একটি সাইকেল রিকশা এসে থামল হাসিদের বাড়ির সামনে। হাসি তখন ক্লাস করতে গেছে। হাসির বাবা অজয়ের সঙ্গে এমনভাবে গল্প করতে লাগলেন যেন তিনি কিছুই জানেন না। যদিও তপনের কাছ থেকে তিনি সব শুনেছেন।

তিনি শুধু একবার জিগ্যেস করলেন, শান্তিনিকেতন জায়গাটা আপনার খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি? পরপর দুবার এলেন?

অজয় পরিষ্কার উত্তর দিলেন, আমি হাসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। হাসি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

হাসিকে খবর দেওয়া হল। সে এসে অজয়কে দেখেই যেন রাগে জ্বলে উঠল। যেন অজয় একজন অনভিপ্রেত অতিথি। সে বেশ কঠোর ভাবে জিগ্যেস করল, আপনি এখানে ফিরে এলেন? আপনার আজই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল না?

অজয় হেসে বললেন, তাহলে কি অন্য কেউ মজা করার জন্য আপনার নামে আমার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল?

হাসির বাবা অল্প বয়েসিদের এইসব গোলমালের মধ্যে থাকতে চাইলেন না। তিনি ঘর থেকে। বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, হাসি তাঁকে ডেকে বলল, বাবা, শোনো, এই লোকটা আমাকে বিরক্ত করছে! জ্বালিয়ে মারছে। এর জন্য আমি রাত্তিরে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছি না।

অজয় তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললেন, আপনার মেয়েকে যদি আমি বিরক্ত করে থাকি, সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। অনুগ্রহ করে এবারের মতন আমাকে মার্জনা করুন। আমি শপথ করছি, আমি জীবনে আর কোনওদিন এই শান্তিনিকেতনে পা দেব না।

অজয়ের নম্র, বিষণ্ণস্বর শুনে বাবা পর্যন্ত বিচলিত হয়ে বললেন, না, না, না আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার মেয়েটা একবারে পাগল, কখন যে কী করে মাথার ঠিক নেই। আপনি বসুন, চা-টা শেষ করুন।

কিন্তু অজয় আর দাঁড়ালেন না। হাসির দিকে একবারও না তাকিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

বিকেলের আগে ট্রেন নেই। দুপুরটা অজয়কে ট্যুরিস্ট লজে কাটাতে হবে। দরজা বন্ধ করে তিনি ঘুম দিলেন। একটুপরেই দরজায় দুমদুম শব্দ হল।

দরজা খুলতেই হাসি ঝড়ের বেগে ঢুকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, আপনি…আপনি অতি নিষ্ঠুর! কেন বললেন যে জীবনে আর কোনওদিন শান্তিনিকেতনে পা দেবেন না? শান্তিনিকেতন কি আমার একলার? গুরুদেবের জায়গায় যে-কেউ আসতে পারে।

অজয় কিছু না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন হাসির মুখের দিকে।

হাসি আবার বলল, আপনি…তুমি…শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেয়ো না, তুমি এখানেই থাক। বিদেশে যাওয়ার কী দরকার? আমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যে যেতে পারব না।

সেই প্রথম অজয় এগিয়ে এসে হাসির হাত ধরে টেনে তুলে তাকে বুকের ওপর এনে বললেন, তুমি চল, কয়েক বছর মাত্র আমরা বিদেশে থাকব। তারপর আবার আমরা ফিরে আসব। তোমার গান বন্ধ হবে না!

অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিবাহ-উৎসবের পরই অজয় ফিরে গেলেন আমেরিকায়। হাসিকে থেকে যেতে হল পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার আর তিনমাস বাকি, কিন্তু সেই সময়টাই হাসির মনে হল বিরাট লম্বা। যে শান্তিনিকেতনকে এত ভালোবাসত হাসি, সেই শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার জন্য সে ছটফট করতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই হাসি দমদম ছেড়ে প্লেন ধরল।

অজয় খান্ডেলকরকে বিদেশে থাকতে হল সাত বছর। মাঝখানে হাসি একবার কয়েক সপ্তাহের জন্য মা-বাবার কাছে ঘুরে গিয়েছিল। বিদেশে হাসির স্বাস্থ্য অনেক ভালো হয়েছে, চোখে-মুখে এসেছে অন্যরকম দীপ্তি, সবসময় সে আনন্দ-উচ্ছল, বিয়েটা তার খুবই সার্থক হয়েছে।

সাত বছর বাদে যখন বিদেশে পাকাঁপাকি বসবাস কিংবা সবকিছু গুটিয়ে দেশে ফেরার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এল তখন হাসির দেশ সম্পর্কে টান অনেকটা কমে গেছে। ওখানে থেকে যাওয়াই তার ইচ্ছে। কিন্তু অজয়ই ফিরতে চাইলেন। দেশ তাঁকে টানে। হাসিকে তিনি ফিরিয়ে আনবেন এই কথা দেওয়া ছিল।

দু-তিন জায়গা থেকে চাকরির অফার পেয়েছিলেন অজয়, তার মধ্যে দিল্লিরটাই সবচেয়ে ভালো ছিল, তবু অজয় কলকাতার চাকরিটাই নিলেন।

সাত বছর পর হাসি তার ফুটফুটে শিশুপুত্রের হাত ধরে ফিরে এল শান্তিনিকেতনে। কলকাতায়। পছন্দমতন বাড়ি পাওয়া যায়নি, অজয় থাকছেন কোম্পানির গেস্টহাউসে, হাসি কিছুদিন বাবা মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে যাবে।



 


চলবে---------------------------------------------

COMMENTS

My Blog List

Name

featured,64,Sad Story,1,slider,65,অন্যান্য,8,ইতিহাস,4,উপন্যাস,12,কবিতা,8,কলাম,4,গল্প,38,ছোট গল্প,15,জীবনী,7,পারিবারিক,6,প্রবন্ধ,9,প্রেম,14,বাস্তবতা,5,বিদ্রোহ,7,বিরহ,8,ভালবাসা,12,ভৌতিক,2,ভ্রমণ কাহিনী,5,ভ্রমন,1,রহস্য,8,রূপকথা,1,রোমান্টিক,5,শিশু সাহিত্য,3,সংকলন,4,সংগ্রহ,2,সংলাপ,2,সামাজিক,7,সাহিত্য,13,স্মৃতিকথা,1,হাস্যরস,1,হুমায়ূন আহমেদ,11,
ltr
item
Golpo Blog: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলৌকিক--(১ম পর্ব)"-------- মধু'র ভূবণ ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলৌকিক--(১ম পর্ব)"-------- মধু'র ভূবণ ।
bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj8FuX2914gy8t8PG21_kSMNDG-TGty5j0WRov2Jb6ekgIXAwW0uhZj3ScfG4hNX4g-cyRVxD_yQsp493Ma0U6FGSDT3xN-h_DehDlJFtt186N1VyptNDYIGdHKNFtWLKH7389c1IDlZhoX/w640-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%258C%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595+%25E0%25A7%25A7+.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEj8FuX2914gy8t8PG21_kSMNDG-TGty5j0WRov2Jb6ekgIXAwW0uhZj3ScfG4hNX4g-cyRVxD_yQsp493Ma0U6FGSDT3xN-h_DehDlJFtt186N1VyptNDYIGdHKNFtWLKH7389c1IDlZhoX/s72-w640-c-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%258C%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595+%25E0%25A7%25A7+.jpg
Golpo Blog
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_32.html
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_32.html
true
3394482685536881275
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy