তিনটি রূপকথার গল্প, বুদ্ধিমান মন্ত্রী, রাজা ও রাজকন্যা, অত্যাচারী বাদশাহ,
তিনটি রূপকথার গল্পঃ- বুদ্ধিমান মন্ত্রী, রাজা ও রাজকন্যা, অত্যাচারী বাদশাহ,
- রূপকথার গল্প : বুদ্ধিমান মন্ত্রী
এই গল্পটি ইরান দেশের। সেখানকার এক বাদশাহ, নাম তার ফরিদ। বাদশাহ’র ছিল অতি বিচক্ষণ এক মন্ত্রী। খুবই জ্ঞানী লোক। তার দুরদর্শিতা ছিল অসাধারন। বাদশাহ তাকেভালোও বাসতেন খুব। রাজ্যের যে কোন বিপদ-আপদে এই মন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। একদিন এক ব্যক্তি বাদশাহ’র কাছেগিয়ে মন্ত্রীরবিরুদ্ধে অভিযোগ করল। –হুজুর, আপনার প্রিয় মন্ত্রী ভিতরেভিতরে আপনার শত্রু। তিনি বহুলোককে রাজকোষ থেকেটাকা ধার দিয়েছেন।
শর্ত একটাই–আপনার মৃত্যুর পরেএই টাকা শোধ দিতেহবে। তিনি চান না যে আপনি দীর্ঘজীবী হোন। আপনারমৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে অনেক অনেক টাকা পয়সা আসবে। কী ভয়ংকর চক্রান্ত–বাদশাহ আপনি একবার ভেবে দেখুন। বাদশাহএই কথা শুনেমন্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত বিরক্তও ক্ষুদ্ধহলেন। সময়মতো একদিন তাকে বললেন– মন্ত্রী, একী কথা শুনতে পাচ্ছি? লোকজনদের টাকা ধারদিচ্ছেন অন্যরকম শর্তে, এর উদ্দেশ্য কী? আমি বেঁচে থাকতে আপনি এই টাকা ফেরত নেবেন না, স্পষ্ট বোঝ যাচ্ছে আমার মৃত্যুতেই আপনার যথেষ্টলাভ।
আপনাকে আমার আন্তরিক বন্ধুবলেই জানি। কিন্তুআপনার এ কেমন শত্রুর মতো আচরণ? — জাঁহাপনা, আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনাকে সবকথা পরিষ্কার ভাবেই খুলে বলা উচিৎ। কিছুই গোপন করা উচিৎ নয়। আমি চাই সমস্ত লোকই আপনার মঙ্গল কামনা করুক। কিন্তু যারা আপনার শত্রুপক্ষ, আপনার বিরুদ্ধেকথা বলে, আমি শুধুতাদেরকেই শর্তসাপেক্ষে টাকা দিয়েছি। শর্তটি হচ্ছে– আপনার মৃত্যুনা-হলে টাকা ফেরত দিতে হবেনা। জাঁহাপনা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, টাকা ধার নিয়ে সহজে সেটা কেউ ফেরতদিতে চায় না। সুতরাং আপনার বিরুদ্ধপক্ষ সারাক্ষণই কামনা করবে– যাতে আপনারমৃত্যুনা হয়। যাতেআপনি সুদীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারেন। টাকার মমতাতেই তারা আপনার পূর্ণ স্বাস্থ্য ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করবে। বাদশাহউত্তর শুনে খুবই সন্তুষ্ট হলেন। মন্ত্রীর বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলেন। তাকে যথেষ্টপুরষ্কার দিলেন। আর মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে লোকটা বদনাম করেছে তাকে শাস্তি দিতেও ভুললেন না।
- রুপকথার গল্প : রাজা ও রাজকন্যা
এক দেশে ছিল এক রাজা। তিনি অনেক ক্ষমতাধর হয়েও সোমগিরির রাজা হিসেবে ছিলেন ভীষণ দয়ালু। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তার ছিল অসীম ভালবাসা। প্রজাদের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা নিয়েই তিনি সারাক্ষণ ভাবতেন। ফলে সেই রাজ্যের মানুষেরা ছিল খুব সুখি। কোনো কিছুর অভাব ছিল না তাদের। তারাও তাদের রাজাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এত কিছু হলে কী হবে! এত শক্তি যে রাজার, এত সম্পদে পরিপূর্ণ যারভান্ডার, এত বিশাল আরমহৎ যারমন, সেই মনের গভীর কোণে ছিল এক নিদারুণ বেদনা। দারুণ অসুখি ছিলেন সেই রাজা। সব থেকেও তার যেন কিছুই নেই।
তিনি যেন ভীষণ একা। সারাদিন আনমনা হয়ে থাকেন। কারণ রাজার একমাত্র সন্তান, রাজ্যের রাজকন্যা খুব অসুস্থ। সে দাঁড়াতেপারে না, বসতে পারে না। কথাও বলতেপারে না। দিন রাত কেবলই তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতেহয়। রাজকন্যার বয়স পনের হলেও, তাকে দেখতে এখনও শিশুটির মতোইলাগে। ভীষণ কষ্টতার। সবার মতো সে চলাফেরা করতে পারেনা, মনের কথা বলার কোনো ভাষাও নেই তার। ক্ষুধা পেলেও কাউকে জানাতে পারেনা। জীবিত থেকেও সেযেন মৃত। সবার মাঝে থেকেও সে যেন সবার থেকে দূরে। দিন যায়, মাস যায়।
ঘুরতে ঘুরতে কয়েকটা বছরও চলে যায়। রাজ্যেরসব বড় বড় ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম-বৈদ্যদের পালা শেষ। দূর-দূরান্তের রাজ্য থেকেও বড় বড় ডাক্তারদের পক্সিখরাজ ঘোড়ায় করে নিয়েআসা হল। কিন্তুকিছুতেই কিছুহল না। সকলেরই এক কথা। এঅসুখ কিছুতেই সারবার নয়। শেষেরাজা আর কী করেন! মনের দুঃখে যেন সব কিছুই ভুলে গেলেন। ভুলে গেলেন তার প্রাণপ্রিয় দেশের কথা, প্রজাদের কথা, এমনকি ভুলে গেলেন আহার-নিদ্রার কথাও। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারেকাউকেকিছুনা বলে বেরিয়ে পড়লেন রাজপ্রাসাদ থেকে।
সবাই যখন গভীর ঘুমেঅচেতন, তখন পোশাক পাল্টে চলে গেলেন রাজ্য ছেড়ে। দিন যায়, মাস যায়, কেউ আর রাজার কোনো সন্ধান পায় না। ঘুরতে ঘুরতে বছরখানেক পরে রাজা এসে পড়লেন এক জঙ্গলে। সে কী ভয়ংকর জঙ্গল! বাঘ, ভাল্লুক আর নানা বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ সেই জঙ্গল। এদিকে রাজার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েগেল। খাদ্যের সন্ধানে রাজা ঘুরে বেড়াতে থাকেন এদিকে সেদিকে। কিন্তুবনের ভেতরে এত গাছ, কোনো গাছে কোনো ফল নেই। অনাহারে-তৃষ্ণায় রাজার প্রাণ যায় যায়। শেষেক্লান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বসে পড়লেন রাজা।
ঠিক সেই সময় গাছের পাশ দিয়ে কলসি কাঁখেযাচ্ছিল এক ছোট্ট মেয়ে। কী সুন্দর মিষ্টি দেখতে! ছোট্টফুটফুটে গোলাকার মুখে দুটি বড় বড় চোখ। আর সেই চোখে যেন রাজ্যের কৌতূহল। রাজা তো ভীষণ অবাক। কী আজব ব্যাপার! এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে এত সুন্দর ছোট্ট মেয়েএল কোথা থেকে? রাজা মেয়েটিকে ডাকলেন। মানুষের কন্ঠ শুনেমেয়েটি তো প্রথমে অবাক। পরে রাজাকে দেখতেপেয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটি এগিয়েযেতেই রাজা বললেন-“মা, দারুণ তৃষ্ণা পেয়েছে। একটুজল খাওয়াবে?” মেয়েটি জল দিতেই রাজা যেন প্রাণে বাঁচলেন।
তারপর বললেন, “কে তুমি মা? এই ভয়ঙ্করজঙ্গলেএকা একা কী করছ? এখানে এলে-ই বা কোথা থেকে?” মেয়েটি জানাল, এই জঙ্গলের মধ্যেই একটা ছোট্টকুটিরে মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা মারা গিয়েছেন জন্মের আগেই। আগে মা আর মেয়ে দুজনে জঙ্গল থেকেফুল তুলে মালা গেঁথেবিক্রি করত। মা অসুস্থ বলে, এখন তাকে একা-একাই সব কাজ করতে হয়। সারাদিন ফুলবিক্রি করেপানি নিয়েবাড়ি ফিরছিল মেয়েটি। আরতখনই রাজার সঙ্গে দেখা। মেয়েটির কথা শুনে ভীষণ দুঃখ হল রাজার। এত ছোট্ট একটি মেয়ে, অথচ কত কষ্টেরজীবন তার! মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়েদিলেন রাজা। এই অভাবিত স্নেহে মেয়েটি একেবারে বিগলিত হয়ে পড়ল।
সে কখনও তার বাবাকে দেখেনি। এই লোকটিকে দেখে তারনিজের বাবার কথা মনে পড়েগেল। বাড়ির পাশে তার বয়সী মেয়েদের সে দেখেছে, তাদের বাবারা তাদের কত আদরকরে। মেলা থেকে কত কী কিনে এনে দেয়। কী সুন্দর বাড়িতে ঢুকেই ‘মা’, ‘মা’ বলে ডাকতেথাকে। কই, তাকে তো কেউএভাবেডাকে না। কতদিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। আজ এই অপরিচিত লোকটিকে দেখে তারমনেহল, তার বাবা বুঝি এমনই ছিল। তার বাবা থাকলেতাকে বুঝি এভাবেই মা বলে ডাকত! চোখ দুটো ছলছল করেউঠল মেয়েটির। সে রাজাকে বলল, “চলুন আমাদের বাড়িতে। আমার মা আপনাকে দেখেখুব খুশি হবেন।” মেয়েটির কথায় রাজা কেমন যেন অভিভূত হয়েগেলেন। মেয়েটিরসঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়েদেখেন, একটি জীর্ণ পর্ণকুটির। ভেতরে একটা পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে এক অসুস্থ নারী। মেয়েটি মায়ের সঙ্গেরাজার পরিচয় করিয়ে দিল।
মেয়েটির মায়ের সঙ্গে অনেক কথা হল রাজার। রাজা কিন্তুনিজের পরিচয় দিলেন না। কেউ বুঝতেই পারল না যে, তিনি আসলে একজন পরাক্রমশালী রাজা। কথা প্রসঙ্গে রাজা জানলেন, এই মেয়েটির জন্ম আর তারনিজের মেয়ের জন্ম একই দিনে। ভীষণ কৌতহল হল রাজার। মেয়েটির প্রতি তার আরও তীব্র মমতা তৈরি হল। সে সারাক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তার সঙ্গে গল্প করে। তার জন্য বন থেকে ফুল কুড়িয়ে আনে। শেষে ফুল দিয়েমেয়েটি মালা গাঁথে। এমনি করেই দিন যায়। মেয়েটিকে পেয়ে রাজা যেন সব দুঃখ ভুলেগেলেন।
মেয়েটিওযেন ভীষণ খুশি। এই মানুষটিকে সেও এক সময় ‘বাবা’ বলেডাকতেশুরু করেদিল। এদিকে এক রাক্ষসটের পেয়ে যায় ব্যাপারটি। সে ভাবে, এমন করেতো আর চলতে দেওয়া যায় না। এভাবে চলতে থাকলে তো একদিন সমস্ত সত্যটাই বের হয়েআসবে। যা করার, এক্ষুণি করতে হবে। সবারআগে মেয়েটার ঘাড়ই মটকাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন বন থেকে রাজার ফিরতেদেরি হয়ে যায়। ওদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসে।
বাবা তো ফিরছে না। দুশ্চিন্তায় মেয়েটি ছোটাছুটি করতে থাকে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে খুঁজতে থাকেবাবাকে। সেই সুযোগে রাক্ষসটি এসেমেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েটি তো ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়। আর ঠিক সেই সময়েই রাজা এসে উপস্থিত। রাক্ষস বধের মন্ত্রও তার জানা। বহুদুষ্টু রাক্ষসকেই এর আগে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। তিনি সরাসরি আক্রমণ করলেন রাক্ষসকে। আর যায় কোথায়, দুজনের মধ্যে শুরুহয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রের জোরেজয় হল রাজারই। রাজা যখন রাক্ষসকেপ্রাণেবধকরতে গেলেন, তখন রাক্ষস কেঁদে-কেটে কাকুতি-মিনতি করে বলল, “হে পরাক্রমশালী বিক্রমপুরের রাজাধিরাজ, দয়া করে আমাকে প্রাণেবধকরবেন না। তারচেয়েবরং আমাকেআজীবন দাস বানিয়ে রাখুন।
বিনিময়েআমি আপনাকে রাজাকে এমন এক সত্য বলব, যার কারণেই আপনার এতকষ্ট।” কী সত্য?রাজকন্যার অসুখের পেছনে কোনো সত্য আছেনাকি? রাজার বেশ কৌতহল হল। তিনি রাক্ষসের প্রস্তাবেরাজি হলেন। তাকে না মেরে জানতেচাইলেন, সেই সত্যের ইতিহাস। রাক্ষসটি তখন বলতে শুরু করল। এই রাক্ষসের মা তক্ষোকিনী রাক্ষসী। তাকে মন্ত্রবলেবধকরেন রাজা। অপরাধ- রাজ্যের প্রজাদের ক্ষতিসাধন। তখন এই রাক্ষস প্রতিজ্ঞা করে, মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও রাজার ক্ষতিসাধন সেকরবেই।
আর সে জন্যই রাজারস্ত্রী যখন সন্তানসম্ভবা, তখন সেজাদুবলে রাণির গর্ভ থেকে রাজকন্যাকেসরিয়ে এই কুটিরের নারীর গর্ভে স্থাপন করেন। রাজকন্যার জন্ম হয় এই কুটিরে। এই মেয়েটি-ই আসলে রাজার মেয়ে, বিক্রমপুরের রাজকন্যা। ওদিকে রাজার ঘরে জন্ম নেওয়া অসুস্থ শিশুটি আসলে রাজকন্যার অর্ধাংশ। ওদের দুজনকে যদি কোনো পূর্ণিমার রাতে এক বিছানায় শোয়ানো যায়, তবে তারা দুয়ে মিলে সম্পূর্ণ মানুষে পরিণত হবে।
রাক্ষসের কথা শুনে রাজা মেয়েটিকে বুকে জড়িয়েনিলেন। মেয়েটিও তার মাকে নিয়ে ফিরেএল রাজপ্রাসাদে। বহুদিন পর রাজাকে পেয়েপ্রজারাও ভীষণ খুশি। সঙ্গে রাজকন্যা পাওয়ার খবরে তাদের তো আনন্দ আর বাঁধ মানলো না। তারপর এক পূর্ণিমা রাতে দুই রাজকন্যাকেএক বিছানায় শোয়ানো হল। পরদিন সকালে দেখা গেল, ঘর থেকে বের হয়েছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী রাজকন্যা। দিনদিন সেবিদ্যা-বুদ্ধিতেও তারপারঙ্গমতারপরিচয় দিতেলাগল। রাজকন্যার রূপ-গুণের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল দেশ দেশান্তরে।
বিক্রমপুরে রাজা-রাজকন্যা-প্রজা সবাই মিলে সুখে-শান্তিতেদিন কাটাতে লাগল। আর সেই দুষ্ট রাক্ষস?রাজার দাস হয়ে দিনরাত তাকে করতে হয় শক্ত শক্ত কাজ। এভাবেই সে তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতেথাকে।
- রূপকথার গল্প : অত্যাচারী বাদশাহ
এক দেশে এক অত্যাচারী বাদশাহ ছিলেন। বিভিন্ন রকমের অত্যাচার তিনি করতেন। লোকজনের ঘোড়া-গাধা জোর করে কেড়ে নিতেন। বাদশাহ একদিন সৈন্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে শিকার করতে গেলেন। দলবল নিয়ে শিকার করতে আসা রাজাদের একটা অভিজাত্য এবং এটা একটা বড় উৎসব। রাজা একা একা একটা শিকারের পেছনে ধাওয়া করতে করতে অনেকদূর চলে গেলেন। তাঁর অন্য কোনদিকে খেয়াল নেই।
তখন সন্ধা। রাজা টের পেলেন বনের মাথায় ঘন আঁধার নামছে। সঙ্গেকোনো অনুচর নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত স্থান। তিনি কাছাকাছি এক গ্রামেগিয়ে আশ্রয় নিলেন। এক ধনবান ব্যক্তির বাড়িতে রাত্রিযাপন করবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন, ধনী ব্যক্তিটি তার গাধাকে বেদম প্রহার করছে। গাধা কাতর হয়ে চিৎকার করছে। লোকটি নির্বিকার। সে গাধার একটা পা ভেঙে দিল। রাজা তাই দেখে লোকটিকে বললেন–
কী হে, অবলা জীবটাকে এভাবে পিটাচ্ছ কেন? গাধার ঠ্যাং ভেঙে তুমি নিজেরশক্তি পরীক্ষা কর? লোকটি উত্তেজিতভাবে জবাব দিল: আমার কাজ ভালো কি মন্দ, আমিই সেটা খুব ভালোভাবেজানি। গায়েপড়ে তোমার কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই।
জবাব শুনেবাদশাহখুব দুঃখ পেলেন। এইভাবে এইনিরীহ প্রাণটিাকে মারা কী কারণ থাকতেপারে দয়া করেসেটা আমাকে বুঝিয়ে বলবে কি? আমারমনে হচ্ছে, তুমি যেশুধুনির্বোধতাইনয় বরং আস্ত একটা পাগল। লোকটি একথায় হেসে বলল: হ্যাঁ, আমি পাগলইবটে। তবে সব শুনলে তুমিও বুঝবে, আমি নির্বোধের মতো গাধাটার পা ভেঙে দিইনি। এরমধ্যে একটা উদ্দেশ্য আছে আমার। আমাদের বাদশাহখুব অত্যাচারী। একথা সবাই জানে। আমার সুস্থ সবল গাধাটির খবরপেলেনিশ্চয়ই তিনি জোর করেএটা নিয়েযাবেন। শুনেছি, আমাদের এইএলাকায় বাদশাহ এসেছেন। তাই গাধাটাকে বাদশাহর অত্যাচার থেকে রক্ষা করবার জন্যে খোঁড়া করেদিলাম।
বাদশাহগাধাটিকে কেড়েনিয়েযাওয়ার চেয়ে খোঁড়া অবস্থায় এটা আমার কাছেথাকা অনেক ভালো। আমাদের অত্যাচারী বাদশাহকে জানাই শত ধিক! বাদশাহগ্রামবাসী লোকটির মুখে নিন্দা শুনে খুবই দুঃখ পেলেন। কোন জবাব দিলেন না। রাগে, অপমানে, দুঃখে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি। ঘুমহীন রাত কাটল। ভোরেরআলো ফুটল পুব আকাশে। মৃদুবাতাসবয়ে যাচ্ছে। পাখির কলকাকলিতে মুখর চারদিক। সৈন্যসামন্ত বাদশাহকে খুজতে খুজতে সাতসকালে হাজির হল সেই গ্রামে। ধনী লোকের বাড়িরসামনেএল তারা।
শত শত লোকজনের মুহূর্তে ভিড় হয়ে গেল। সুসজ্জিত ভৃত্যেরা বাদশাহর সেবায় নিয়োজিত হল। সেই বাড়ির সামনে জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল দরবারবসে গেল। রাজ্যের প্রধান প্রধান ব্যক্তি রাজার সামনেএসেআসন গ্রহণ করলেন। রাজকীয খানাপিনার আয়োজন করা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই এলাকার সম্পূর্ণ পরিবেশ পালটে গেল। সৈন্যদল ওঘোড়ার পদভরে থরথর করে কাঁপতে লাগল সেই এলাকা।
বাড়িরসেই লোকটি ব্যাপারস্যাপার দেখে একেবারে থ। গতরাতেস্বয়ং বাদশাহ ছিলেন তার অতিথি। অর্থাৎ বিপদ ঘনিয়েএসেছে। বাদশাহ ডেকে পাঠালেন লোকটিকে। ধরে বেঁধে তাকে আনা হল বাদশাহ’র সামনে। লোকটি বুঝল, তারআত্মরক্ষার আর কোন উপায় নেই। এই মুহূর্তেই তার জীবন শেষ হবে। আর ভয় করা বৃথা। কারণ উদ্যত তরবারির নিচেই মানবের ভাষা অধিকতর শক্তিশালী হয়েথাকে।
তাই লোকটি সাহসের সঙ্গে বলল– হে মহামান্য বাদশাহ, আমি একাই শুধু আপনার নিন্দা করি নাই। খবর নিয়ে দেখুন, জনসাধারণ সকলেই একই কথা বলে থাকে। আমাকে সহজেই হত্যা করা আপনারপক্ষেসম্ভব। আমার কথায় আপনি মনে আঘাত পেয়েছেন–সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনার উচিৎ হবে ভালো কাজ করা– যেন কেউ আপনার বদনাম করতে না পারে। অন্যায় করে কখনই সুনাম অর্জন করা সম্ভব নয়।
আপনার কর্মচারীরা সারাক্ষণ আপনার গুণকীর্তন করে থাকে। এতে রাজার সম্মান বৃদ্ধি পায় না। প্রজারা যদি বাদশাহ’র সুনাম করে, তাতেই বাদশাহ’র সম্মান বাড়ে। বাদশাহ এই সাহসী সত্যকথা শুনে দারুন উদ্দীপ্ত হলেন। লোকটিকে মুক্ত করে দিলেন। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন: আমি আজথেকে চেষ্টা করব ন্যায়পরায়ন, সুশাসক হতে। আমি চাই একজন ভালো বাদশাহ হতে। যেন আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দিক দিগন্তরে।
- আরও ইন্টারেস্টিং অংশ জানতে 'Mr Modhu'(Invisible Poetry)
- ধন্যবাদান্তে 'Mr Modhu'
COMMENTS