bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প
"অভিদার কথা" (২য়--পর্ব)
প্রথম পর্বের পর,,,,,,,,,,,,
এটাকে বাংলায় যাকে বলে মস্ত বড় ফাঁড়া। একে তো জল একেবারে বরফের মতন ঠান্ডা, আমি সাঁতার জানলেও ওভারকোট সমেত অত জবরজং পোশাক নিয়ে সাঁতার কাটাও যায় না। আর। স্টিমারের চাকার নীচে পড়ে যাওয়ার খুবই সম্ভবনা। আমি ছাড়া অন্য দুজন সাহেব, তাদের। মধ্যে একজনকে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, পরে সে বেঁচেছে কি না জানি না। আমি উদ্ধার পেয়ে গেলুম অক্ষতভাবে।
কাগজে এই খবর ছাপা হয়েছিল। দেশে ফেরার পর দেখি, অনসূয়ার চিঠি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
তার ভগবানের ক্রোধ আমাকে ইউরোপ পর্যন্ত তাড়া করে গেছে? কথায় বলে, রাখে কৃষ্ণ মারে কে? আর আমার বেলায় কৃষ্ণই বারবার আমাকে মারতে চেষ্টা করছে? আমি এটা ভাবতে চাই না। অনসূয়ার চিঠিই আমাকে মনে করিয়ে দেয়।
প্রত্যেকবার এরকম কিছু ঘটার পর আমি মনে-মনে তেজের সঙ্গে বলি, কই হে, ভগবান, আমার কিছু করতে পারলে? তোমার মুরোদ তো বোঝা যাচ্ছে। চালিয়ে যাও, চেষ্টা চালিয়ে যাও।
আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই। তবু এরকম মনে হওয়াটাই তো এক হিসেবে আমার পরাজয়। ভূতে বিশ্বাস না করে ভূতে ভয় পাওয়ার মতন।
অনসূয়ার এবারের চিঠিটা একটু অন্যরকম। যেন তার ঈশ্বর, তার জীবন স্বামীর প্রতি এতদিনে খানিকটা অভিমান হয়েছে। কেন তিনি আমাকে ক্ষমা করতে পারছেন না? কেন তিনি। প্রতিশোধস্পৃহা ভুলতে পারছেন না। সেইজন্য, সে নিজের কাঁধে সব দোষ নিয়েছে। শাস্তি হিসাবে মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছে।
ইস, বড় সুন্দর চুল ছিল মেয়েটার। কিন্তু আমি কী করতে পারি? সে-ই তার ঈশ্বরকে বারবার দায়ী করছে, আমি তো করছি না? মানুষ কি জীবনে একবার-দুবার আছাড় খায় না? মানুষ তো অনেক সময় শুকনো জায়গাতেও আছাড় খায়। মদ্যপান করার পর আমি সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় খুব সাবধানে নামি। কখনও দুর্ঘটনা হয়নি। একবার পোর্টে একটা জাহাজে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলুম। প্রচণ্ড খাওয়ার পর দড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়েছিল। ঠিক পেরে গেছি!
কদিন আগে নিজের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দিনদুপুরে পা পিছলে পড়ে গেছি। কলার খোসা ছিল না, কিছু ছিল না। তবু এরকম হতেই পারে। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম। একটা গানের সুর কিছুতেই মনের মতন হচ্ছিল না। পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছি, কদিন বাদে সেরে তো যাবেই। তবু এরমধ্যে। আবার অনসূয়ার সেই কাতর চিঠি। যেন এটাও তার ভগবানের কীর্তি।
ভগবানের কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই? বিশ্ব সংসার সামলাবার কথাও সে ভুলে গেছে? এ। দেশে কত গরিব-দুঃখী, অনাথ-আতুর রয়েছে, তাদের জন্যও মাথাব্যথা নেই, শুধু ঘুরছে আমার পেছন-পেছন? মাত্র দু-খানা চুমুর জন্য এত?
ট্রেন প্রচুর লেট, ভিক্টোরিয়া টারমিনাসে পৌঁছল সন্ধেবেলা। অভিদা আগেই বলে রেখেছিলেন, আমার হোটেলে ওঠা চলবে না। ওঁর দুজন সহকারী গাড়ি নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিল, অভিদার পায়ের অবস্থা বেশ খারাপ, ধরাধরি করে নিয়ে যেতে হল। মালাবার হিলসে একটা সতেরোতলা। বাড়ি, তার সবচেয়ে উঁচু তলায় অভিদার ফ্ল্যাট। ঠিক সমুদ্রের দিকেই একটা চওড়া বারান্দা,। সেখানে দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। মুম্বইতে এলেই আমার মনে হয়, ইস কলকাতা শহরটা কেন যে সমুদ্রের ধারে হল না। তিন শয়নকক্ষের প্রশস্ত অ্যাপার্টমেন্ট, মস্ত বড় বসবার ঘর, একদিকে খাওয়ার জায়গা, দু-হাজার স্কোয়ারফুট তো হবেই। এখানে অভিদা একা থাকেন, একজন বাবুর্চি তাঁর রান্নাবান্না করে দেয়, রীতিমতন উর্দিপরা বাবুর্চি, মাথায় টুপি, ইংরিজিও বোঝে।
গায়ক ও সুরকারের বাড়িতে নানারকম গান-বাজনার যন্ত্র তো থাকবেই। অত্যাধুনিক মিউজিক। সিস্টেম। কিন্তু বেশি চোখে পড়ে বই। একটা ঘরের তিনদিকের দেওয়াল জোড়া, বড়-বড় র্যাক ভরতি বই, যত্ন করে রাখা। বহুরকমের বই, সাহিত্য, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন ও অনেক রকমের ধর্মগ্রন্থ। ইস, এরকম একটা জায়গায় যদি আমি টানা একবছর থাকার সুযোগ পেতাম!
এইসব বাড়িতে সবাই লিফটে ওঠানামা করে। অভিদা তাহলে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেলেন কী করে?
সেকথা জিগ্যেস করতেই তিনি বললেন, লিফটে উঠি ঠিকই, নামবার সময় হেঁটে নামি ইচ্ছে করে। এমনিতে তো ব্যায়াম-ট্যায়াম কিছু করি না, তবু নামবার সময় শরীরে কিছু নাড়াচাড়া হয়। এরকম দশবছর নামছি, হঠাৎ একদিন পা হড়কে গেছে। সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
—অভিদা, তোমাকে কি প্রত্যেকদিনই পার্টিতে যেতে হয়?
—নিজের কাজের জন্য যেতে হয় না, তবে, একটা-না-একটা ছবির মহরত তো লেগেই আছে, তারা ডাকে। কোনও ছবি দশসপ্তাহ চললেই শুরু হয়ে যায় সেলিব্রেশন। তা ছাড়া আজ এর জন্মদিন, কার ওর বিবাহ বার্ষিকী। তুই বিশ্বাস করবি না, এখানে কারও ডির্ভোস হলেও পার্টি হয়।
—তাহলে তুমি নিজের জন্য সময় পাও কখন?
—এরই মধ্যে সময় বার করে নিতে হয়। জীবনটা এরকমই চলছে, আর ফেরানো যাবে না। অনেক মানুষের জীবন মাটিতে আঁকা আলপনা, আর আমাদের মতন মানুষের জীবন হাউই কিংবা রকেট। আমাদের আয়ু কম হয়। কিন্তু আমাদের ছটা বেশি। যে যেটা বেছে নেয়! তবে যত রাতই হোক, আমি প্রত্যেকদিন ভোরবেলা উঠি। পরে দুপুরে খানিকটা ঘুমিয়ে-টুমিয়ে নিই, ভোরে ওঠা অভ্যেস হয়ে গেছে। তখন কিছুক্ষণ ধ্যান করি।
—ধ্যান করো? কীসের ধ্যান?
—যারা ধর্ম-টর্ম মানে, যাদের খুব ভক্তিভাব থাকে, তারা প্রত্যেকদিন পুজো-প্রার্থনা করে। নামাজ পড়ে। আমাদের ওসব ঝামেলা নেই। তবু আমাদেরও কিছু-না-কিছুর সাধনা করতে হয়। এটা আমি আমার এক জ্যাঠামশাইয়ের কাছে শিখেছি।
—চোখ বুজে ধ্যান করো? তখন কীসের কথা ভাবো? কী দ্যাখো?
—রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, গান্ধীজি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, এঁদের ছবি মনের চোখে ভেসে ওঠে। এঁরাই তো এ-যুগের দেবতা। ছেলেবেলায় গান শিখিনি তেমন, এখন গলা। সাধি, কঠিন-কঠিন রাগ গলায় তোলার চেষ্টা করি। তাতেই সকালবেলা মনটা ভালো হয়ে যায়। আর হ্যাঁ, লিভার ভালো রাখার জন্য নিমপাতার রস খাই। রবীন্দ্রনাথ মদ খেতেন না, তবু নিমপাতার রস খেতেন।
আটটা বাজতে-না-বাজতেই অভিদা বললেন, অনেকক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে, এখন আহ্নিক শুরু করতে হবে যে! গেলাস, সোডা আর বরফ দিতে বল। ওই কাবার্ডে বোতল আছে অনেক রকম, তোর যেটা ইচ্ছে নিয়ে আয়। সুনীল, তুই আমেদাবাদ গিয়ে কী করবি? এখানেই থাক না কদিন।
আমি বললাম, ওদের কথা দেওয়া আছে যে! স্টেশনে অপেক্ষা করবে।
কথা দিয়ে সব কথা রাখিস বুঝি? বেশ-বেশ, অভ্যেসটা ভালো। আমার অবশ্য ধাতে নেই। তুই কবিতা-টবিতা তো লিখিস বুঝলাম, আর কিছু করিস?
—একটা খবরের কাগজে…
—সেই টিপিক্যাল ব্যাপার। সাহিত্য করতে গেলেই হয় খবরের কাগজে, আর নয় তো ইস্কুল কলেজে মাস্টারি। সব জায়গায় এরকমই দেখি। অথচ যারা সাহিত্য রচনা করবে, তাদের সারা দেশ, এমনকি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো দরকার, মানুষকে চেনা দরকার। ছোট একটা গণ্ডির মধ্যে থেকে…
—ওসবের জন্য অনেক টাকা লাগে, অভিদা।
—টাকা রোজগার করলেই পারিস। বড়-বড় উর্দু কবিরা এখানকার সিনেমার জন্য গান লিখে অনেক টাকা রোজগার করে। আবার নিজস্ব কবিতাও লেখে। তোরা বাঙালিরা পারিস না কেন?
বাংলা সিনেমায় তো স্কোপ নেই।
—এখানে চলে আয়! তোর বয়েস এখনও কম, জীবনটা নিয়ে কী করবি ঠিক করেছিস? একটা কিছু জীবনদর্শন তো থাকা দরকার।
—সত্যি কথা বলছি, অভিদা সেরকম কিছু ঠিক করিনি। খানিকটা কনফিউজড অবস্থা বলতে পারো।
—তোকে আমার গল্পটা শোনাবার আগে জিগ্যেস করা হয়নি, তুই ধর্ম-টর্ম মানিস?
—তেমনভাবে মানি না, আবার উড়িয়েও দিতে পারি না। মন্দিরেটন্দিরে মাথা ঠুকি না। কিন্তু সরস্বতী মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।
—সেটা অন্য ব্যাপার। লিবিডোর ব্যাপার।
—আচ্ছা অভিদা, উত্তর কলকাতায় তোমাদের বাড়িতে নিত্য তিরিশ দিন রাধাগোবিন্দর পুজো হতে দেখেছি। ছেলেবেলায় আমরা প্রসাদও খেয়েছি। সেই বাড়ির ছেলে হয়ে তুমি নাস্তিক হলে কী করে?
—ওই মন্দিরটাই আসল কারণ। তুই জগদীশ্বর সেন-এর নাম শুনেছিস?
—জগদীশ্বর সেন…মানে যিনি ইতিহাসের বই লিখেছেন?
—হ্যাঁ।
–বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন, তার মধ্যে একটা আমার দারুণ লেগেছে, টোটেম অ্যান্ড রিচুয়ালস, এ-বইটার বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত।
—ওই জগদীশ সেন আমার জ্যাঠামশাই। কলকাতা ইউনিভার্সিটির কারমাইকেল অধ্যাপক ছিলেন। আমার বাবারা সাত ভাই, চার বোন। জ্যাঠামশাই সবচেয়ে বড়। বাড়ির তিনি একজন প্রধান শরিক।
অন্য ভাইদের সঙ্গে তাঁর গণ্ডগোল লেগেছিল ওই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের নিত্যপূজা নিয়ে।
পড়ন্ত অবস্থায় বেশিরভাগ শরিকের কোনও রোজগার নেই। মন্দিরে প্রতিদিন। দু-বেলা পুজো চালাতে তো খরচ আছে, কে দেবে। এ ওকে ঠেলাঠেলি করে। একদিন বড় জ্যাঠামশাই সবার সঙ্গে এক সঙ্গে খেতে বসেছেন, হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন, মন্দিরের পুজো বন্ধ করে দাও। পঞ্চ ধাতুর বিগ্রহটা পুরোনো,
ওটা দান করে দেওয়া হোক মিউজিয়ামে। মন্দিরটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। এখন আমাদেরই ঘরে কুলোচ্ছে না, মন্দিরটা ভেঙে ওখানে অনায়াসে একটা তিনতলা বাড়ি উঠতে পারে। কিছু ভাড়া দিলে রোজগারও হবে।
চলবে,,,,,,,,,,,,,
COMMENTS