সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অসোক উপাখ্যান"------ মধু'র ভূবণ ।

SHARE:

bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প 
 
                      "অসোক উপাখ্যান"


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প,  "অসোক উপাখ্যান"------ মধু'র ভূবণ ।






যতদূর মনে পড়ে, ছেলেবেলায় একবারই মাত্র বাবার কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল অশোক। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। সাত বছরই তো, তখন সে ক্লাস টু-তে পড়ে। তখনও আলিপুর পার্ক রোডের বাড়িটা তৈরি হয়নি, ওরা থাকত চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের হলদে রঙের তিনতলা বাড়িটায়, সে বাড়ির সামনে কোনও বাগান ছিল না, খেলবার কোনও জায়গাই ছিল না।

সেই দিনটা নিশ্চয়ই ছিল রবিবার কিংবা কোনও ছুটির দিন। কারণ, ঘটনাটা ঘটেছিল বেলা একটা বা দেড়টার সময়, ছাদে খুব গনগনে রোদ ছিল অশোকের স্পষ্ট মনে আছে। ছুটির দিন না হলে ওই রকম সময়ে তো বাবা বাড়িতে থাকতেন না, অশোকেরও স্কুলে থাকার কথা। অবশ্য। অনেক ছুটির দিনেও বাবাকে দেখতে পেত না অশোক। বাবা খুবই ব্যস্ত মানুষ, প্রায়ই তাঁকে। কাজের জন্য যেতে হত দিল্লি, বোম্বাই, আমেদাবাদ। মাসে অন্তত দু-বার যেতেন বাঙ্গালোরে, সেখানে বাবার আর একটা অফিস ছিল।

চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের সেই বাড়িটায় অনেক ঘর ছিল, তার মধ্যে তিনতলার দুটো ঘর ভরতি বোঝাই ছিল বাবার অফিসের খাতাপত্র। সেই ঘরে ছোটদের ঢোকা নিষেধ। বাবা কলকাতার বাইরে থাকলে ঝি-চাকররাও সেই দুটো ঘরে ঝাড়-পোঁচ করতে ঢুকত না।

তবু সেই সাত বছর বয়েসে, দুপুরবেলা অশোক চুপিচুপি ঢুকেছিল বাবার একটা অফিস ঘরে। বাবা তখন পাশের ঘরেই কাজ করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

সেই অফিস ঘরটায় ছিল দুটো স্টিলের আলমারি আর একটা চেয়ার ও একটা টেবিল। অশোকের স্পষ্ট মনে আছে, সে ঘরে একটার বেশি চেয়ার ছিল না। বাবার যে দু-তিনজন। কর্মচারী ওই ঘরে দেখা করতে আসত তারা সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা বলত। দরজার বাইরে জুতো খুলে ঢুকত তারা। অবশ্য এক-তলায় তাদের মস্তবড় একটা বসবার ঘর ছিল, তার একদিকে সোফা সেট, আর একদিকে চৌকির ওপর ফরাস পাতা।

অশোক সেই ঘরে ঢুকে টেবিলের ডানদিকের দেরাজ খুলে ফেলেছিল আস্তে-আস্তে। সেটা চাবি দেওয়া ছিল না। তার মধ্যে হাত ঢোকাতেই অশোক পেয়ে গিয়েছিল জিনিসটা। একটা রিভলভার।

অশোকের নিজের খেলনা বন্দুক-পিস্তল ছিল। এই জিনিসটা প্রায় সেই রকমই দেখতে। অশোকের খেলনা বন্দুক পিস্তল দেখলে কেউ ভয় পায় না, বরং হাসে। চরতাম কিংবা ভূপী ভাইয়া কিংবা লছমীকে যখন অশোক তার খেলনা পিস্তল দিয়ে গুলি করে, তখন তারা দু-হাতে বুক চেপে ধরে আ মর গয়া বলে হাসতে থাকে। কিন্তু বাবার হাতে এই পিস্তলটা দেখে। সরকারজি ভয়ে কাঁপছিল কেন?

দৃশ্যটা অশোক দেখে ফেলেছিল আড়াল থেকে। ছাদের পেছন দিকের কার্নিস দিয়ে উঁকি মারলে এই ঘরের ভেতরটা দেখা যায়। লছমী দুধ খাওয়াতে এলেই অশোক ছাদের চতুর্দিকে দৌড়ে দৌড়ে পালাত। আগের দিন সকালে সেই রকমভাবে দৌড়তে-দৌড়তেই অশোক একবার। একেবারে এক কোণে এসে পড়ে কার্নিস ধরে ওঠবার চেষ্টা করছিল, তখনই সে দেখতে পেল যে বাবা এই পিস্তলটা উঁচিয়ে কড়া গলায় সরকারজিকে বলছেন, হাঁ, আমি বাংগালি লোকদের বেশি ফেভার করি, বেছে-বেছে তাদের নোকরি দিই, তাই বলে তোমরা আমার শির পর চড়ে বসবে? কুত্তেকে আওলাদ, তোর ছাতি আমি ছুঁড়ে দেব! বেইমান কাঁহিকা…

সরকারজি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছিল, ঝুপ করে নীচু হয়ে বাবার পা ধরে কাঁদতে লাগল।

দৃশ্যটা দেখে বেশ মজা লেগেছিল অশোকের। সাত বছর বয়েসে সব ঘটনার মর্ম বোঝা যায় না। একজন কেউ ভয় দেখাচ্ছে, আর একজন ভয় পাচ্ছে, শিশুর মনোজগতে এই তো মানব সমাজের স্বাভাবিক দৃশ্য। জন্ম থেকে এই রকমই তো তারা দেখে। এর মধ্যে যে ভয় দেখায়, যে কোনও শিশু তাকেই পছন্দ করে, সেও ওই রকমই একজন হতে চায়।

অশোকের চোখে বাবা একজন বীরপুরুষ। সেই জন্য সে বাবার খেলনাটা নিতে চেয়েছিল।

রিভলভারটা হাতে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সে জানে, তার হাতে এটা দেখলে লছমী বা ভূপী ভাইয়ারা ভয় পাবে না, খেলনা পিস্তলই ভাববে। তাকে এখন সরকারজির মতন কাল্পনিক কয়েকটি প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিতে হবে, সেই জন্য ছাদে যাওয়া দরকার।

কিন্তু লছমীই আগে তাকে দেখতে পেল। অমনি সে চেঁচিয়ে উঠল, আরে-আরে, ছোটবাবু তুম পিতাজীর ঘরে ঘুষেছিল? ওটা কী নিয়েছ? আরে বাপ রে বাপ!

অশোকের বাবার ঘুম খুব পাতলা। তিনি লছমীর চিৎকার শুনেই বাইরে ছুটে এসেছিলেন। কনিষ্ঠ সন্তানের হাতে রিভলভারটি দেখা মাত্র তিনি চিনে ফেললেন, দারুণ আতঙ্কে তাঁর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। তাঁর মনে পড়ে গেল, রিভলভারটি লোড করা এবং খুব সম্ভবত সেফটি ক্যাচ আটকান নেই।

তিনি কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, অশোক বেটা, কেন আমার জিনিস নিয়েছ? তুমার কত্তো টয় আছে, রাখ দো, জমিন পর রাখ দো, ধীরে-ধীরে।

অশোক রিভলভারটি উঁচিয়ে খলখল করে হেসে বলেছিল, পিতাজি, ডিসুম! ডিসুম।

তৎক্ষণাৎ রঘুবীরপ্রসাদ উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। তাঁর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, এলোমেলো গুলি ছিটকে আসবে। ছেলেটা নিজেই মারা পড়তে পারে—

বাবাও সরকারজির মতন ভয় পেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছেন দেখে আরও মজা পেয়েছিল অশোক। তাহলে বাবার চেয়েও সে বড় বীরপুরুষ! এই খেলাটা তো চমক্কার!

সে রিভলভারটার মুখ ঘোরাল বাবার দিকে।

মাটি থেকে মুখ না তুলে রঘুবীরপ্রসাদ বলে যাচ্ছিলেন, লছমী, উসকো পাকড়ো, অশোকবেটা, উয়ো টয় রাখ দো, অনেক ভালো ভালো টয় দিব, চকোলেট, পেস্ট্রি, যযা তুমি মাঙবে…লছমী, মাইজিকো তুরন্ত বোলাও, অশোক বেটা, এইসা মাৎ কর না, তুমার পিতাজি মরে যাবে—

শেষপর্যন্ত অবশ্য দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি। অশোকের মা এসে পড়েছিলেন! মা একটুও ভয় পাননি। মা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, দে, ওটা আমায় দে। অশোক, দুষ্টুমি করিসনি, দে বলছি!

অশোক তবু দিতে চায়নি, মা হঠাৎ দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলে হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন রিভলভারটা।

তখন দেখা গেল বাবার রাগ। এর আগে তিনি অশোককে কোনওদিন কড়া কথা বলেননি পর্যন্ত। সেদিন মাটি থেকে উঠে এসে তিনি অশোকের সামনে দাঁড়িয়ে গর্জন করতে লাগলেন। অশোকের হাতে তখন আর অস্ত্র নেই, বাবার শারীরিক শক্তি বেশি, সেইজন্য তিনি ভয় দেখাতে পারলেন ছেলেকে। শুধু ভয় দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, শেষ পর্যন্ত রাগ সামলাতে না পেরে দুটো চড় কষিয়ে দিলেন।

সেই ঘটনা অশোক কোনওদিন ভুলতে পারেনি। এর কয়েকমাস পরেই অশোককে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দার্জিলিংয়ের কনভেন্ট স্কুলে। ছুটিতে বাড়ি এলে বাবা খুব ভালো ব্যবহার করতেন। অশোকের কোনও শখ মেটাতে বাবা কখনও কার্পণ্য করেননি।

অশোকের যখন সতেরো বছর বয়েস, তখনই বাবা তাকে একটি ফিয়াট গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। অশোকের নিজস্ব গাড়ি। এক বছর বয়েস বাড়িয়ে অশোক সেই সময়েই ড্রাইভিং লাইসেন্স করে নিয়েছিল।

কৈশোর পার হওয়ার পর অশোক বাবার একটা অন্য পরিবর্তন লক্ষ করেছিল। বাবা আগে প্রায়ই বাংলা বলতেন, বাংলা অনেকটা ভালোই শিখেছিলেন। কিন্তু আজকাল আর বাংলা বলতেই চান না। বাড়িতে কেউ বাংলায় কথা বললে তিনি স্পষ্ট বিরক্ত হন।

অশোকের মাতৃভাষা বাংলা, কিন্তু সে বাঙালি নয়।

রঘুবীরপ্রসাদ ছাত্র বয়েসে একবার শান্তিনিকেতনে দোল উৎসব দেখতে গিয়েছিলেন। সেই উৎসব দেখে তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে তিনি মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বাঙালি মেয়ে বিয়ে করবেন। যেন ইচ্ছেটা কাজে পরিণত করা খুব সহজ ছিল না। তিনপুরুষ ধরে তাঁদের পরিবার কলকাতাবাসী হলেও বিয়ে-শাদী হয় রাজস্থানে। রঘুবীরপ্রসাদের বাবা জবরদস্ত লোক ছিলেন, তাঁর অমতে যাওয়ার সাধ্য রঘুবীরপ্রসাদের ছিল না। স্বজাতির মধ্যেই বাবার মনোনীত পাত্রীকে বিয়ে করতে হল। কিন্তু সেই স্ত্রীর মৃত্যু হল এক বছরের মধ্যেই।

তার তিন বছর পর, রঘুবীরপ্রসাদ তাঁর বাবার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর তাঁর সাধ পূর্ণ করেছিলেন। পুণ্যশীলা রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় দেরাদুনে। রঘুবীরপ্রসাদের কাছ থেকে বিবাহ প্রস্তাব রায়চৌধুরী পরিবার প্রত্যাখান করতে পারেনি।

বিয়ের পর কিছুদিন রঘুবীরপ্রসাদ বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অনেকখানি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ঘন-ঘন বাংলা সিনেমা-থিয়েটার দেখতে যাওয়া, বাড়িতে বাংলা গানের রেকর্ড, কিছু কিছু বাঙালি রান্না। বংশগত ভাবে নিরামিষাশী হলেও একদিন চিংড়ি মাছ চেখে দেখলেন এবং পছন্দও করলেন।

কিন্তু এই প্রতি বেশিদিন টেকেনি। ব্যাবসা জগতে তিনি বাঙালি কর্মচারীদের কাছ থেকে বারবার আঘাত পেয়েছেন। তাদের তিনি বেশি-বেশি সুযোগ দিলেও তারা বিশ্বাসের মূল্য দিতে পারেনি। তাছাড়া, এদের অনেকের মুখেই একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপের হাসি লেগে থাকে, এটাই তার অসহ্য মনে হয়। দু-পয়সার মুরোদ নেই, তবু একটা সবজান্তা ভাব। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন যে বাঙালি জাতটা নিমকহারাম। যতই এদের দাও, একটু পেছন ফিরলেই নিন্দে শুরু করবে। বাঙালিরা নিজের যা পারে না, অন্য কেউ তা পারলেও ওরা তা মেনে নিতে শেখেনি।

পুণ্যশীলার একটা বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি পরপর পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, প্রত্যেকটিই ছেলে। এইসব পরিবারে পুত্রসন্তানের বড় কদর। অবশ্য সব ভারতীয় পরিবারেই তাই, তবে ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েরা শুধু যে সম্পত্তির একটা বড় অংশ নিয়ে চলে যায় তাই-ই নয়, ব্যবসায়েও ভাগ বসাতে চায়।

অশোকের ওপরের চারটি ভাই-ই বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। প্রত্যেকেই মাঝারি ধরনের লেখাপড়া শিখে ব্যাবসাতে মন দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের নানা প্রান্তে।

অশোক একেবারে ছোট ছেলে বলেই হয়তো বেশি-বেশি মা ঘেঁষা! বড় হয়ে অশোক জানতে পারে যে বাঙ্গালোরে তার বাবার একটি রক্ষিতা আছে। তার দাদারাও এ ব্যাপারটা জানে, কিন্তু। তারা কেউ এ নিয়ে মাথায় ঘামায় না। রঘুবীরপ্রসাদকে প্রায়ই বাঙ্গালোরে গিয়ে থাকতে হয়, তাঁর সেবা যত্নের জন্য সেখানে একজন মেয়েমানুষ রেখে দিলে দোষের কী আছে? কিন্তু এই ব্যাপারটা জানতে পেরে অশোক যেন আরও বেশি তার মাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। মা-ও কি জানে? অশোক মাকে জিগ্যেস করতে সাহস পায়নি। মা যেন বড় বেশি চাপা। মা সকলের সেবা যত্ন। করেন, হাসেন, বই পড়েন, কিন্তু মনে-মনে তার সম্পর্কে যে কী ভাবেন তা বোঝা যায় না।

অশোক সাবালক হয়ে ওঠার পর তাকেও মায়ের আঁচল ছাড়া করে ব্যাবসায় লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রঘুবীরপ্রসাদ। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা ব্যাপার ঘটে গেল।

সতেরো বছর বয়েসে একটা নিজস্ব ফিয়াট গাড়ি পেয়ে অশোক যেখানে-সেখানে চরকি দিয়ে বেড়াত। ততদিনে রঘুবীরপ্রসাদ পশ্চিমবাংলার এগারোখানা পেট্রল পাম্পের মালিক, সুতরাং অশোকের পেট্রলের কোনও চিন্তা নেই।

এক টিপিটিপি বৃষ্টিপড়া সন্ধেবেলা অশোক মোমিনপুরের মোড়ের কাছে উলটোদিক থেকে আসা একটা বাসকে কাটাতে গিয়ে হঠাৎ বাঁ-দিকে ঘুরে গিয়ে এক ভদ্রমহিলা আর তাঁর সঙ্গের একটি সাত-আট বছরের মেয়েকে চাপা দিল। গাড়ির ধাক্কায় দুটো শরীরই ছিটকে পড়ল মাটিতে, গাড়ির চারটে চাকা চলে গেল তার ওপর দিয়ে, মড়মড় করে শব্দ হল। পুরো ব্রেক করার পরও গাড়িটা বিকট শব্দ করে থামল একটু দূরে। অশোক পেছন ফিরে তাকাল।

গাড়িতে অশোকের এক বন্ধু ছিল। সে কোনও কথা না বলে দরজা খুলে নেমেই এক দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। অশোক আর কিছু ভাববার সময় পেল না, সেও গাড়ি থেকে নেমে দৌড় মারল।

বৃষ্টির জন্য রাস্তায় বেশি লোক ছিল না। কেউ তাকে তাড়া করে আসেনি। অশোক অন্ধের মতন ছুটতে-ছুটতে কোথায় যে গিয়ে পড়ল তা সে জানে না। এই শহরে সে এতদিন আছে কিন্তু কোনওদিন পায়ে হেঁটে ঘোরার অভ্যেস নেই। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে সে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারত! কিন্তু তার মাথার মধ্যে কোনও যুক্তি কাজ করছিল না। মাথাটা যেন ফাঁকা। তার কী নাম, কোথায় বাড়ি এসব কিছুই যেন মনে নেই।

অনেক রাতে জল কাদা মেখে, খালি পায়ে অশোক ফিরে এল বাড়িতে। ততক্ষণে তার বোধ ফিরে এসেছে। বাড়ির বাইরে কোথাও রাত কাটাবার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না। তা ছাড়া তার কাছে টাকাকড়িও বিশেষ নেই। কোথায় আর যাবে, বাড়িতেই তো ফিরতে হবে! কিন্তু বাবা কী বলবেন, সেই ভয়েই সে কাঁপছিল থরথর করে।

বাড়ি ফিরে সে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল পাগলের মতোন। সে কান্না আর থামেই না। দুঃখ বা ভয়ের কান্না নয়, তার মধ্যে সত্যিই যেন মিশে ছিল খানিকটা পাগলামি। মা অনেক প্রশ্ন করে-করে ঘটনাটা জেনে নিলেন। রঘুবীরপ্রসাদ সেদিন কলকাতাতেই ছিলেন, তিনি সব শুনে বললেন, বেওকুফ, গাড়ি কাঁহে ছোড়কে আয়া?

কলকাতা শহরে কোনও গাড়ি মানুষ চাপা দিলে সে গাড়ি আর থামে না। থামলেই জনতা এসে আক্রমণ করবে। গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ যখন ছিল, তখন অশোক কেন গাড়িটা। অকুস্থলে ফেলে এল? রঘুবীরপ্রসাদের ছেলে এত দুর্বল কেন হবে?

পরদিন ভোরেই অশোককে পাঠিয়ে দেওয়া হল দিল্লিতে।

এই ঘটনার ফলে কয়েকটি অনভিপ্রেত প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। দুর্ঘটনাস্থলেই বাচ্চা মেয়েটি মারা যায়, তার মা দুদিন হাসপাতালে থেকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। তবু অশোকের নামে কোনও মামলা-মোকদ্দমা হয়নি, রঘুবীরপ্রসাদের ব্যবস্থাপনা এমনই নিখুঁত। এমনকি কয়েকদিন বাদে খানিকটা কাচ-টাচ ভাঙাচোরা অবস্থায় গাড়িটাও ফেরত এনেছিলেন। খবরের কাগজে এই দুর্ঘটনার সায় দিয়ে তাঁদের পরিবারের কোনও উল্লেখও ছিল না।

কিন্তু এই উপলক্ষে পুণ্যশীলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর একটা ঘোরতর মনোমালিন্য হয়। ব্যাবসার ব্যাপারে তাঁর স্বামী কোথায় কত নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছেন তার সব খবর তিনি রাখতেন না। কিন্তু এত বড় একটা মর্মান্তিক ব্যাপারের পরও রঘুবীরপ্রসাদের হৃদয়হীনতা তিনি ঠিক সহ্য করতে পারেননি। মামলা-মোকদ্দমা চাপা দেওয়া হয়েছে তা ঠিক আছে, যে-দুটি প্রাণ গেছে অন্য একজনকে শাস্তি দিলে তো তাদের ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে পরিবারটির ওপর এত বড় বিপদ নেমে এল তাদের তো সাহায্য করা যায়। রঘুবীরপ্রসাদের তো টাকা পয়সার অভাব নেই।

রঘুবীরপ্রসাদের বক্তব্য হল, টাকা পয়সার প্রশ্ন নয়, এই রকম ঘটনার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের নাম জড়ানোটাই মুখতা। টাকা পয়সা তিনি গ্রাহ্য করেন না, পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তাঁকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে।

তীব্র বিদ্রুপের সঙ্গে তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন যে, অত বেশি বাঙালি-বাঙালি কোরো না। যে-সব পুলিশ তাঁর কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছে, লেবার কোর্টের যে হাকিম মামলা ডিসমিস করে দিয়েছে, তারা বাঙালি নয়?

অনেককাল পরে পুণ্যশীলা রাগ করে তিনমাসের জন্য বাপের বাড়িতে গিয়ে রইলেন। আর ওদিকে দিল্লীতে অশোকের মাথার গোলমালের স্পষ্ট লক্ষণ দেখা গেল। প্রায়ই তার মনে হয়, কয়েকটা ধারালো নখযুক্ত আঙুল তার মাথার ভেতরটা চিরে দিচ্ছে। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, তারপর হাউহাউ করে কাঁদে।

এদেশে কিছুদিন চিকিৎসার পর অশোককে পাঠিয়ে দেওয়া হল আমেরিকায় তার এক পিসতুতো দাদার কাছে। সেখান থেকে দু-বছর বাদে সে ফিরে এল নতুন মানুষ হয়ে। চেহারা তো ভালো হয়েছেই, ব্যবহারও অনাড়ষ্ট, কথাবার্তা ঝকঝকে।

ফেরার সঙ্গে-সঙ্গেই রঘুবীরপ্রসাদ অশোককে জড়িয়ে ফেললেন ব্যাবসার কাজে। মায়ের সংস্পর্শে থেকে সে যাতে আবার দুর্বল না হয়ে পড়ে সেইজন্য তাকে দেওয়া হল রাঁচী অফিসের ভার।

বিদেশ থেকে অশোক এই তত্বটি আরও ভালো করে শিখে এসেছে, অস্ত্র হাতে তুলে নাও, প্রতিযোগীদের ধ্বংস করো! অস্ত্র মানে আর বন্দুক-পিস্তল নয়, অস্ত্র হল টাকা। তুমি টাকা বাড়িয়ে যাও, অন্য সবাই এসে তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে।

অশোক টাকা বাড়ানোর নেশায় মেতে উঠল। সে এখন সম্পূর্ণ নির্দয়। কোনও কর্মচারী তার নির্দেশ মানতে সামান্য গাফিলতি করলেই অশোক তাকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেয়। কেউ তার কথার প্রতিবাদ করলে অশোক তাকে ধনেপ্রাণে মারে। পেট্রোলে কেরোসিন মেশাও, সিমেন্টে গেঁড়িমাটি মেশাও, তাতে টাকা বাড়বে। সরকারের কন্ট্রাক্ট নেওয়ার পর মাল সাপ্লাই না দিয়ে বিল সাবমিট কর, কয়েক পারসেন্ট এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দাও, তোমার টাকা বাড়বে। নতুন। কারখানা খোলা হবে বলে আদিবাসীদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করো, ঠিকেদারদের হাত করে ওদের ঝুপড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দাও! এম-এল-এ আর মন্ত্রীদের মাঝে-মাঝেবি এন আর হোটেলে ডেকে এনে খাওয়া-দাওয়াও আর হাতে একটি করে খাম ধরিয়ে দাও তারপর দেখো কেমন করে ওরা তোমার পা চাটে!

কয়েক বছরের মধ্যে রঘুবীরপ্রসাদকেও স্বীকার করতে হলো যে এ ছেলে তার দাদাদেরও ছাড়িয়ে যাবে। তার উন্নতি প্রায় সরল রেখায় চলেছে, একটুও বাঁক নেই। নতুন-নতুন ব্যাবসার দিকে ঝুঁকছে সে। এখন অশোক যা ছুঁচ্ছে তাই-ই সোনা হয়ে যাচ্ছে। একজন সরকারি অডিটারকে অশোক এমন নিখুঁত কায়দায় খুন করালো যে সে ব্যাপারে কেউ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারল না। রঘুবীরপ্রসাদ একেবারে চমৎকৃত হয়ে গেলেন। এই ছেলের বিয়ে দেওয়ার। কথা তিনি ভাবছিলেন, এবার ঠিক করলেন আর একটু অপেক্ষা করা যাক। এ-ছেলে যেমন ভাবে উঠছে তাতে বিড়লা বা খৈতান বা জৈনদের বাড়ি থেকেই অশোককে জামাই করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করবে নিশ্চয়ই।

বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে অশোক অবশ্য এর মধ্যে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েকে রক্ষিতা করেছে, বাইরে অবশ্য তার পরিচয় অফিস সেক্রেটারি।

তারপর একদিন আর একটা ঘটনা ঘটল।

জুলাই মাসের এক শনিবার অশোক জরুরি কাজে রাঁচী থেকে খড়গপুর আসছিল গাড়িতে। এখন অশোক নিজে গাড়ি চালায় না, ড্রাইভার থাকে। আর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীও থাকে সব সময়, যে আসলে তার বডি গার্ড।

ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে সকাল থেকেই, সেই জন্য গাড়ির গতি একটু ধীর। পেছনের সিটে বসে অশোক ব্যাবসার কাগজ-পত্র পড়ে যাচ্ছে। একটা হাত তার রক্ষিতা বনাম সেক্রেটারি স্টেলার উরুর ওপর রাখা! স্টেলা অবশ্য ঢুলছে অনেকক্ষণ ধরে।

বাহারাগোড়ার একটু আগে দেখা গেল রাস্তার ওপরে বেশ ভিড়। দুপাশে অনেক গাড়ি জমে গেছে। একটা পুলিশের গাড়িও দেখা যাচ্ছে।

কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে অশোক জিগ্যেস করল, কেয়া হুয়া?

ড্রাইভার বলল, অ্যাকসিডেন্ট মালুম হোতা।

বিরক্তিতে অশোকের ভুরু কুঁকড়ে গেল। লাঞ্চের আগেই তার খড়গপুরে পৌঁছনো দরকার। কিন্তু রাস্তা এমন জ্যাম হয়ে আছে যে গাড়ি এগোবার কোনও উপায় নেই।

একটুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অশোক গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। স্টেলা ঘুমিয়েই রয়েছে। অল্প অল্প বৃষ্টি এখনও পড়ছে, তার মধ্যেও এত লোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে। হাইওয়ের ওপরে এত মানুষ আসে কোথা থেকে? অশোক এগিয়ে গেল পায়ে-পায়ে।

বেশ বড় রকম দুর্ঘটনা। একটা ট্রাক রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে পাশের শাল গাছে। একটা সাদা রঙের ফিয়াট গাড়ি ত্যারচাভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ফিয়াট গাড়িতে চাপা পড়েছে এক গ্রাম্য মহিলা আর একটি বাচ্চা মেয়ে। প্রকাশ্য দিনের আলোয় এরকম দুর্ঘটনার কোনও কারণই নেই, কিন্তু ফিয়াট গাড়ির ড্রাইভার নাকি ঘুমে ঢলে পড়েছিল।

ডেড বডি দুটো এখনও সরানো হয়নি, রাস্তার পাশে চাপ-চাপ রক্ত বৃষ্টির জন্যেও ধুয়ে যায়নি। ঝাড়গ্রাম থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসবে, সেই জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনার পর ফিয়াট গাড়িটি পালাতে পারেনি, কারণ তার ব্রেক জ্যাম হয়ে গেছে। ঘটনাটার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা পুলিশের গাড়ি এসে পড়েছিল বলে উত্তেজিত জনতা মারধোর বা ভাঙচুরের তান্ডব শুরু করতে পারেনি। অবশ্য এরা শহরের জনতা তোনয়, তাই চট করে ক্ষিপ্ত হয় না। ফিয়াট গাড়িটিতে শুধু চালক ছাড়া আর কেউ ছিল না, সেই চাকলটি পুলিশের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

এই দুর্ঘটনার দৃশ্যটি অশোকের মনে প্রথমে কোনও দাগ কাটেনি। সে খালি অস্থির হয়ে ভাবছিল, খড়গপুর পৌঁছতে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে, ব্যবসার কাজে লোকসান হয়ে যাবে, পুলিশ তো আগে রাস্তাটা পরিষ্কার করে দিলেই পারে।

ফিয়াট গাড়ির চালকটি একবার মুখ ফেরাতেই অশোক তাকে ভালো করে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মধ্যে কামানের গোলার মতন প্রচণ্ড একটা শব্দ হল। এ কী! লোকটিকে অবিকল অশোকের মতন দেখতে। একরকম উচ্চতা, একরকম গায়ের রং, নাক-চোখেরও দারুণ মিল। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে কথা বলছে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে।

ফিয়াট গাড়ির চালকটির মুখে কোনও ভয়ের চিহ্ন নেই। দেখলেই বোঝা যায় সে যথেষ্ট অর্থবান। সে টাকা পয়সার অস্ত্র উঁচিয়ে ধরলেই পুলিশ থেকে আরম্ভ করে আর সবাই তার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াবে।

কিন্তু অশোক অহেতুকভাবে সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেল। তার মনে হল, যদি জনতা তাকে ওই লোকটির যমজ ভাই মনে করে? সবাই মিলে যদি তেড়ে আসে তার দিকে? কেউ অশোককে লক্ষ্য করছে না, তবু অশোক দু-হাতে মুখ চাপা দিয়ে নেমে গেল রাস্তার পাশের নালায়। তারপর অশোক আর আগের অশোক রইল না।

সে ভুলে গেল খড়গপুরে তার জরুরি কাজের কথা, তার গাড়ির কথা, স্টেলার কথা। তার নাম যে অশোক তাও বোধহয় আর তার মনে নেই।

নালাটা পেরিয়ে সে চলে গেল ওপারে। তারপর একটা ছোট শালের জঙ্গল। অশোক সেই জঙ্গলে ঢুকে ছুটতে লাগল। এখন সে খালি শুনতে পাচ্ছে মড়মড় শব্দ। কতকগুলো ধারাল নখযুক্ত আঙুল যেন তার মাথাটা চিরে দিচ্ছে। সে ফিরে গেছে তার সতেরো বছর বয়েসে, সে যেন। মোমিনপুরের মোড় থেকে তার গাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে।

ছুটতে-ছুটতে কয়েকবার হোঁচট খেয়ে, দু-একবার দম নিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর অশোক এক জায়গায় এসে একেবারে থামল। সেখানে অদিবাসীদের একটা হাট বসেছে। একটা খেজুর গাছের তলায় বসে অশোক হাঁপাতে লাগল জিভ বার করে। তার খালি এখন একটাই ইচ্ছে করছে, কোনক্রমে মায়ের কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু মায়ের কাছে কী করে পৌঁছনো যায় তা আর অশোক এখন জানে না। প্রায় বছর দেড়েক হল সে তার মাকে একবার চোখেও দেখেনি।

একটু পরে একজন আধা মাতাল ভিখিরি এসে অশোকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এ-বাবু, একগো রুপিয়া দিবি?

অশোক কোনওদিন ভিখিরিদের পয়সা দেয়নি, কিন্তু আজ সে কোটের পকেটে হাত ঢোকাল। তার কাছে টাকা পয়সা কিছু নেই। বড়লোকরা সঙ্গে টাকা রাখে না, তাদের থাকে চেক বই, ডাইনাশ ক্লাবের কার্ড ইত্যাদি। খুচরো দু-পাঁচশো টাকা অশোক তার বডি গার্ডের কাছে রাখে সবসময়।

ভিখিরিটিকে পয়সা দিতে পারল না অশোক, কিন্তু তার হাত ঘড়িটা খুলে দিল। যেন এখন সে এই ঘড়িটার কোনও মূল্য বোঝে না। লোকটা নির্বিবাদে ঘড়িটা নিয়ে জুয়া খেলার বোর্ডের দিকে গেল। ওখানে ঘড়ি ভাঙিয়ে টাকা পাওয়া যায়।

এরপর আর-একটি লোক এসে হাত পাতল তার কাছে। অশোকের বাঁ-হাতে দুটো আঙটি, দুটোই খুলে সে দিয়ে দিল তাকে। সঙ্গে-সঙ্গে আর একজন ওর হাত থেকে কেড়ে নিল একটা।

তারপর রটে গেল যে একটা বাবু যা চাওয়া হচ্ছে, তাই দিয়ে দিচ্ছে। ধেয়ে এল আরও অনুগ্রহ। প্রার্থীরা। যেহেতু অশোক সব জিনিসেরই মূল্য ভুলে গেছে তাই সে দিয়ে দিতে লাগল সব কিছু। তার সিগারেট কেস, লাইটার, তার কোট, সার্ট, এমনকি প্যান্টলুন পর্যন্ত।

এরও পরে একজন উলঙ্গ লোক এসে বলল, এ-বাবু, আমায় কিছু দিবি না?

শুধু জাঙ্গিয়া ছাড়া অশোকের আর কিছু নেই। সেটাও সে খুলে দিল বিনা দ্বিধায়। তারপর সে আর বাবু শ্রেণিতে রইল না। জল কাদার মধ্যে উলঙ্গ অবস্থায় শুয়ে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একজন জংলি মানুষ হয়ে গেল।

বিকেল যখন শেষ হয়ে এসেছে, হাট ভাঙবার মুখে কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরল তাকে। প্রথমে তারা ভেংচি কাটতে লাগল, তারপর অশোকের কাছ থেকে কোনওরকম সাড়া না পেয়ে তারা ছুঁড়তে লাগল ছোট-ঘোট চিল, কেউ-কেউ লাথি মারতে লাগল তার গায়ে।

প্রয়াগের মেলায় সম্রাট অশোক সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ধর্মাশোক হয়েছিলেন। আর এখানে, এই নাম না জানা অদিবাসীদের হাটে অশোক একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েও, সাধারণ পাগলের ভাগ্যে যা জোটে তাই ভোগ করতে লাগল।

COMMENTS

My Blog List

Name

featured,64,Sad Story,1,slider,65,অন্যান্য,8,ইতিহাস,4,উপন্যাস,12,কবিতা,8,কলাম,4,গল্প,38,ছোট গল্প,15,জীবনী,7,পারিবারিক,6,প্রবন্ধ,9,প্রেম,14,বাস্তবতা,5,বিদ্রোহ,7,বিরহ,8,ভালবাসা,12,ভৌতিক,2,ভ্রমণ কাহিনী,5,ভ্রমন,1,রহস্য,8,রূপকথা,1,রোমান্টিক,5,শিশু সাহিত্য,3,সংকলন,4,সংগ্রহ,2,সংলাপ,2,সামাজিক,7,সাহিত্য,13,স্মৃতিকথা,1,হাস্যরস,1,হুমায়ূন আহমেদ,11,
ltr
item
Golpo Blog: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অসোক উপাখ্যান"------ মধু'র ভূবণ ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অসোক উপাখ্যান"------ মধু'র ভূবণ ।
bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg4Efpe8PmxwD0eTvvEOlUG6RjLSMxUbkdfkG3SJfpeqDNkjazT9Q_lld-vTstW18Oi2fSvHFKOiC1d0DCzrZD3ztlYA-bIq8dVT1FUB1QacydPUZ2vLMPCa-c6gU3_U2-doldfEF-DCTVZ/w640-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B6%25E0%25A6%2595+%25E0%25A6%2589%25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A3+.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg4Efpe8PmxwD0eTvvEOlUG6RjLSMxUbkdfkG3SJfpeqDNkjazT9Q_lld-vTstW18Oi2fSvHFKOiC1d0DCzrZD3ztlYA-bIq8dVT1FUB1QacydPUZ2vLMPCa-c6gU3_U2-doldfEF-DCTVZ/s72-w640-c-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B6%25E0%25A6%2595+%25E0%25A6%2589%25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A3+.jpg
Golpo Blog
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_53.html
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_53.html
true
3394482685536881275
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy