bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প
"অলৌকিক" (২য়--পর্ব)
কিন্তু এই কবছরেই শান্তিনিকেতন যেন অনেক বদলে গেছে। হাসির বন্ধু বান্ধবীরাও প্রায় কেউই নেই। শান্তিনিকেতনের গাছপালাও হাসিকে চিনতে পারল না। তপন থাকে দুর্গাপুরে, সেখানে গানের স্কুল খুলেছে, মাঝে-মাঝে বাংলা সিনেমায় উপ-নায়কের পার্ট করে।
বয়স্ক নারী-পুরুষরা ছাড়া আর কেউ হাসির সঙ্গে যেচে কথা বলে না। গানের জন্য এক সময় হাসির কত নাম ছিল, সেকথা কেউ মনে রাখেনি। এমন কি মোহরদিও তার নামটা ভুলে গিয়েছিলেন।
হাসিও অবশ্য গানের চর্চা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অজয় ব্যবস্থা করেছিলেন সবরকম, দেশ থেকে হারমোনিয়াম আর তানপুরা আনিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকতম রেকর্ড ক্যাসেট কিছুই বাদ ছিল না। তবু হাসির উৎসাহ চলে গেছে আস্তে-আস্তে।
হাসিও অবশ্য গানের চর্চা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অজয় ব্যবস্থা করেছিলেন সবরকম, দেশ থেকে হারমোনিয়াম আর তানপুরা আনিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকতম রেকর্ড ক্যাসেট কিছুই বাদ ছিল না। তবু হাসির উৎসাহ চলে গেছে আস্তে-আস্তে।
শান্তিনিকেতনে সবাই মিলে রিহার্সালের সময় কতরকম মজা, মাঝে-মাঝে কলকাতায় ফাংশান করতে যাওয়া, অন্য গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা, তার নেশাই ছিল অন্যরকম। বিদেশে সারাক্ষণ কাজ করতে হয়, তারপর সন্তান জন্মের পর হাসি আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে মাঝে-মাঝে আপন। মনে দু-চার লাইন গেয়ে ওঠে বটে, কিন্তু সে আর গানের জগতে নেই।
হাসি গায়িকা হয়নি বটে কিন্তু সে সুখী জীবন পেয়েছে। কিংবা খুব সহজেই সুখটাকে মেনে নিয়েছে বলে সে শিল্পী হতে পারল না।
তিন
সেদিন এমন কিছু নেশা হয়নি দিব্যর যে পরেরদিন সে কথা মনে থাকবে না।
লজ্জিত হওয়ার চেয়েও সে বিস্মিত হয়েছিল অনেক বেশি। কেন সে অমনভাবে অনসূয়া খান্ডেলকরের কাছে ছুটে গিয়েছিল অত রাতে? এটা তো নিছক অন্যমনস্কতা নয়! এ তো পাগলামি। অনসূয়ার সঙ্গে তার অতি সামান্য আলাপ, ভদ্রমহিলার চেহারা সুন্দর, ব্যবহারও বেশ ভালো, সকলেই তাকে পছন্দ করে। দিব্যর ক্ষেত্রেও তার বেশি কিছু নয়, সে অনসূয়ার প্রেমে পড়েনি, তাকে নিয়ে সে কোনও স্বপ্নও দেখে না। তাহলে?
দিব্য বেশ ভয় পেয়ে গেল। তার মেজমামা এমনই হিংস্র উন্মাদ যে তাঁকে বছরের পর বছর একটা নার্সিং হোমে রাখতে হয়। দিব্যর মধ্যেও সেই পাগলামির বীজ ঢুকেছে নাকি?
দিব্য দু-তিনদিন খুব মনমরা হয়ে রইল। অফিসে গেল না। কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার কথা চিন্তা করেও যেতে সাহস হল না। সে চুপচাপ বাড়িতে শুয়ে কাটাল।
ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে কি বলে দিয়েছেন সেই রাত্রির ঘটনা? বলাটাই স্বাভাবিক।
দিব্য অজয় খান্ডেলকরের অধীনে কাজ করে না, তার অফিস আলাদা, কিন্তু তার অফিসের স্বার্থে তাকে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হয়। তার অফিস থেকে মাঝে-মাঝেই পাটি দেওয়া হয়, অনসূয়া খান্ডেলকর সেখানে আসেন।
দিব্য বিষণ্ণভাবে ভাবল, হয়তো এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। অজয় খান্ডেলকর তার নামে অভিযোগ করলে দিব্যদের অফিসের জি. এম. আর দিব্যকে রাখবেন না। কারণ, অজয় খান্ডেলকরের মূল্য অনেক বেশি। যদিও দিব্যর নামে দুশ্চরিত্রতার অভিযোগ শুনলে জেনারেল ম্যানেজার প্রথমবার একেবারে হাঁ হয়ে যাবেন।
চেষ্টা করলে দিব্য একটা অন্য চাকরি পেয়ে যাবে। তার যোগ্যতা আছে। কিন্তু এই অফিসটা তার বেশ পছন্দ ছিল। চাকরি জীবনে মাইনে ছাড়াও পছন্দ মতন সহকর্মী পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।
চারদিন পরে দিব্য আবার অফিসে গেল এবং কারুর মুখে কোনও ব্যাঁকা কথা শুনল না। কেউ কিছু জানে না। সবই আগের মতন স্বাভাবিক।
কিন্তু দিব্যর ব্যবহার অনেক আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সে মেপে-মেপে কথা বলে। যে কোনও জায়গায় যাওয়ার আগে সে ভেবে নেয় ঠিক জায়গায় যাচ্ছে তো? বাথরুম থেকে বেরুবার আগে অন্তত। তিনবার দেখে নেয় জামা-প্যান্ট ঠিক মতন পরা হয়েছে কি না!
শনিবার তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অশোক বাজপেয়ীর বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন ছিল, দিব্য কায়দা করে এড়িয়ে গেল। অশোকের বাড়িতে গেলেই খুব মদ্যপান হয়, অশোক খুব জোর করে। দিব্য এখন বেশ কিছুদিন মদ ছুঁতে চায় না। যথেষ্ট মদ খেলেও তার নেশা হয় না এই গর্ব ছিল, এক। সন্ধেবেলা সব উলটে গেল। এয়ারপোর্ট হোটল থেকে সে ছুটে গেল যোধপুর পার্ক, এটা মাতলামি পাগলামি?
মহাশ্বেতা! নামটা একেবারে কাল্পনিক নয়। কিন্তু কতদিন আগে হারিয়ে গেছে সেই মহাশ্বেতা। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঘাটশিলায়, তখন দিব্যর বয়েস একুশ-বাইশ হবে। তার গায়ে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গন্ধ।
মহাশ্বেতারাও বেড়াতে এসেছিল। মহাশ্বেতাদের খুব বড় পরিবার! এক দঙ্গল লোক! মহাশ্বেতার বয়েস সতেরা-আঠারো হবে। তার বয়েসী আরও দুটি মেয়ে ছিল ওদের দলে। তাদের নাম মনে নেই। পাশাপাশি বাড়িতে থাকা তাই আলাপ পরিচয় হবেই। তারপর কিছু হাসি-ঠাট্টা, একসঙ্গে বেড়ানো, কোনও লোকজনের দিকে গাঢ় চোখে তাকান, এর বেশি আর কিছু না।
দিব্য তখন খুব লাজুক ছিল। অন্য অনেক ছেলে যেমন কথার পিঠে চালাক-চালাক কথা বলে, সে ক্ষমতা তার একেবারেই ছিল না। মহাশ্বেতার সঙ্গের অন্য দুটি মেয়ে বরং বেশ স্মার্ট। মহাশ্বেতা একটু চুপচাপ ধরনের।
ওই তিনজনের কোনও একজনের সঙ্গেই দিব্যর প্রেম হয়নি, মনে রাখবার মতন কিছু ঘটেনি।
শুধু একটা বিকেলে, সেদিন বোধহয় ধারাগিরির দিকে সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। একসঙ্গে, মহাশ্বেতা তাকে বলেছিল, আমার মাঝে-মাঝে ভীষণ মন খারাপ হয়! কোনও কারণ নেই, এমনি-এমনি, কেন যে হয় বুঝতে পারি না। কী করে মন খারাপ ভালো করা যায় বলতে পারেন?
অতিরিক্ত লাজুক লোকরা অনেক সময় রূঢ় হয়। সেই রকমভাবেই দিব্য বলেছিল, আমি কী করে জানব, আমি কী ডাক্তার?
মহাশ্বেতার মুখখানা ডিমের মতন। তার মুখের রঙ চাপা জ্যোৎস্নার মতন। ভুরু দুটি খুব গভীর। তখনও তার ভুরু প্লাক করার বয়েস হয়নি। খুব একটা সাজগোজের দিকেও মনোযোগ ছিল না।
গভীর ভুরু দুটি তুলে আহত বিস্ময়ের সঙ্গে সে বলেছিল, বাঃ শুধু ডাক্তাররাই বুঝি মন খারাপের কথা বোঝে? আর কেউ বোঝে না? এই যে বিকেলের আলো কমে আসছে, একটা দিন চলে যাচ্ছে, আকাশটা কী রকম হারিয়ে যাচ্ছে, এই সময়টায় আমার বেশি মন খারাপ হয়। আপনার হয় না?
দিব্য বলেছিল, না।
মহাশ্বেতা বলেছিল, আপনি বুঝি খুব গোঁয়ার? শুনেছি গোঁয়ার লোকদের মন খারাপ হয় না। আপনার সত্যিই কখনও হয় না?
দিব্য আবার বোকার মতন বলেছিল, না!
মহাশ্বেতা বেশ কয়েক মুহূর্ত দিব্যর চোখের দিকে চেয়ে থেকে খুব নরম ভাবে বলেছিল, ও এই সব মানুষদের আমার ভয় করে।
তারপর সে আস্তে-আস্তে একা হেঁটে গিয়েছিল জঙ্গলের দিকে।
লাজুক দিব্য তখন এইটুকু শুধু বুঝেছিল যে মহাশ্বেতাকে সে ভুল কথা বলেছে। মহাশ্বেতা মনে একটু আঘাত পেয়েছে। কিন্তু ঠিক কী কথা তাকে বলা উচিত ছিল তা দিব্যর মনে পড়েনি।
মহাশ্বেতা যখন একলা চলে গেল তখনও সে একটা পাথরের ওপরেই বসে রইল, ওর সঙ্গে গেল না। মহাশ্বেতার সঙ্গে ঠিক কোন কথা বলতে হবে, সেটাই যে সে জানে না।
মহাশ্বেতার সঙ্গে দিব্যর আর কোনওদিন দেখা হয়নি। দিব্য যদি চালু ছেলে হত, তাহলে মহাশ্বেতাকে কলকাতায় ঠিকই খুঁজে বার করত, যোগাযোগ রাখত। কিন্তু দিব্য তখন ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝে-মাঝে ধারাগিরির কাছে সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ত। মহাশ্বেতাকে কী উত্তর দেওয়া উচিত ছিল?
বছর দেড়েক বাদে দিব্যর ছোট বোন একদিন বলল, দাদা, ঘাটশিয়াল সেই যে মহাশ্বেতা বলে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মনে আছে! ইস কী কাণ্ড!
মহাশ্বেতার লম্বাটে মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল দিব্যর। হ্যাঁ তাকে মনে আছে, অন্য কোনও কারণে নয়, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে।
দিব্য জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তার?
রিনি বলল, আজ কাগজে দ্যাখোনি? সে আত্মহত্যা করেছে। কাগজে লিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মহাশ্বেতা সেনগুপ্ত শ্লিপিং পিল খেয়েছে, তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।
তৎক্ষণাৎ দিব্যর মনে পড়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতার প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা। দিব্যর বলা উচিত ছিল, আমাকে তোমার মন খারাপের খানিকটা ভাগ দাও। গোঁয়ার লোকদের শিখিয়ে দাও, কী করে মন খারাপের ভাগ নিতে হয়!
সেইদিন ধারাগিরির কাছে বিকেলে ঠিকঠিকভাবে মহাশ্বেতাকে এই কথাটা বলতে পারলে হয়তো সে আত্মহত্যা করত না। হয়তো এই প্রশ্ন সে আরও কারু-কারুর কাছে করেছে, কেউ সঠিক উত্তর দেয়নি!
তারপর কতদিন কেটে গেছে, একেবারে হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা। দিব্য তার বুকের মধ্যে কোনও অপরাধবোধ পুষে রাখেনি, কেনই বা রাখবে?
অনসূয়ার সঙ্গে তো মহাশ্বেতার কোনও মিল নেই! যতদূর সে জানে, অনসূয়া খান্ডেলকরের জীবন খুব সুখী আর পরিতৃপ্ত। দিব্য তার কাছে কেন গিয়ে বলবে…। না, দিব্য কিছুতেই তার নিজের ব্যবহারের যুক্তি খুঁজে পায় না।
সোমবার দিব্য অফিসে গিয়েই শুনল যে অজয় খান্ডেলকর তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
জেনারেল ম্যানেজার বললেন, শোনো দিব্য মিঃ খান্ডেলকর তোমায় বেশ পছন্দ করেন, আমি আগেও লক্ষ্য করেছি। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মিঃ খান্ডেলকরকে আমরা উইথ। ফ্যামিলি কাশ্মীরে একটা গুড ট্রিটমেন্ট দিতে চাই। ওখানে আমরা একটা সেমিনারের আয়োজন করব। সেটা হবে প্রধানত ওঁরই জন্য। তোমাকে খুব কায়দা করে কথাটা পাড়তে হবে। উনি যেন বুঝতে না পারেন যে ওঁর জন্য স্পেশাল কিছু করা হচ্ছে। তুমি ওঁর কাছ থেকে একটা ডেট নিয়ে এসো। তুমি এটা পারবে, আমি জানি।
দিব্য মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।
দিব্য অবশ্য মনে-মনে ঠিকই বুঝেছে, শুধু তাকে আলাদা করে ডাকার মানেটা কী! অজয় খান্ডেলকর খুব কড়া ধরনের নীতিবাগিশ মানুষ। বাইরে অত্যন্ত ভদ্র, কিন্তু নিজের বিশ্বাসে সব সময় স্থির থাকেন। এইবারে তিনি দিব্যকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়বেন।
দিব্যকে হয়তো আজই চাকরিটা ছাড়তে হবে, তবু সে ঠিক করল তার যাওয়া উচিত। নইলে ছিচকে অপরাধীর মতন মনে হবে নিজেকে। অজয় খান্ডেলকর যা খুশি বলার পর সে ক্ষমা চাইবে।
অজয় খান্ডেলকর বসেন চৌরঙ্গি অঞ্চলের উঁচু বাড়ির ষোলতলায়। তাঁর ঘর থেকে সম্পূর্ণ ময়দান ও তার একপ্রান্তে গঙ্গার বাঁক দেখতে পাওয়া যায়। খিদিরপুরের জাহাজগুলো দেখা যায় স্পষ্ট।
অজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দিব্যর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, আসুন-আসুন। ওঃ, আজ রোদ বড় চড়া, আসতে আপনার কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই। একটা খুব জরুরি পয়েন্ট ক্লিয়ার করার কথা, সেই জন্যই আপনাকে ডেকেছি।
সত্যিই অফিস সংক্রান্ত একটা জরুরি ব্যাপার। অজয় কোনওরকম ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুললেন না। একটা ইমপোর্ট লাইসেন্সের ব্যাপারে দিল্লি থেকে আপত্তি জানিয়েছে, তবু তাড়াতাড়ি তার উত্তর পাঠাতে হবে। প্রায় সওয়া ঘণ্টা ধরে দুজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি আলোচনা করল।
তখনও কাজ বাকি থেকে গেল খানিকটা। কিন্তু অজয়কে বেরুতে হবে, তাঁর একটা জরুরি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে অজয় বললেন, আমি দুঃখিত, দিব্যবাবু, কাজটা শেষ করা গেল না। অথচ কালই উত্তর পাঠানো দরকার।
দিব্য বলল, আমি কাল সকাল ঠিক সাড়ে নটায় আবার আসতে পারি।
অজয় হুঁ, বলে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগলেন।
দিব্য এই সুযোগে কাশ্মীরের প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলল। অজয় সে সম্পর্কে বেশি আগ্রহ প্রকাশনা করে বললেন, ওসব পরে ভেবে দেখা যাবে। আপনি আজ সন্ধেবেলা বিশেষ কিছু করবেন? ফ্রি আছেন?
দিব্য একটু অবাক হয়ে বলল, না তেমন কিছু নেই। কেন বলুন তো!
অজয় হেসে বললেন, আমি ভাবছিলুম, আপনি যদি আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে আসতে পারেন। কাজটাও শেষ করা যায়, খানিকটা গল্পগুজবও করা যায়। অফিসের সময়টা তো আমরা সবাই যন্ত্রের মতন, তাই না? যেন আমাদের কোনও সামাজিক পরিচয় নেই।
দিব্য চুপ করে চেয়ে রইল।
কোনও অসুবিধে আছে?
না।
তাহলে চলে আসুন। আমার বাড়ি চেনেন তো! এই সাড়ে সাতটা নাগাদ! হ্যাঁ, আমাদের ওখানেই খেয়ে নেবেন! তা হলে ওই কথা রইল?
দিব্য একবার জানলা দিয়ে ময়দানের দিকে তাকাল। এত উঁচু থেকে সব কিছুই সুন্দর দেখায়। এখান থেকে আত্মহত্যা করা কত সোজা। একটুও ভয় করবে না।
বাইরে বেরিয়ে এসে দিব্যর মনে হল, অজয় খান্ডেলকর কি একটা ফাঁদ পেতে তার মধ্যে। দিব্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু তাঁর ব্যবহারে কোনওরকম ধূর্ততার চিহ্ন নেই। তাঁর এই যে ভালোমানুষী ব্যবহার, এর সবটাই অভিনয় হতে পারে? কিন্তু অজয় খান্ডেলকর অফিসের কাজে কোনওদিন কারুকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন, এরকম শোনাই যায় না।
তবে কি সমস্ত ব্যাপারটাই স্বপ্ন? সেদিন রাতে দিব্য যায়নি যোধপুর পার্কে। কিন্তু তার মানি ব্যাগ, ঘড়ি খোয়া গিয়েছিল…
অফিস একটু ছুঁয়েই বাড়ি চলে এল দিব্য। তারপর বেশ খানিকক্ষণ ঘুমলো। ঘুম থেকে উঠে খুব ভালোভাবে স্নান করল। ঘুম আর স্নান, এই দুটোতেই মন বেশ স্নিগ্ধ থাকে অনেকক্ষণ। মনের
এইরকম অবস্থায় নিজে বেশি কথা না বলে অন্যের কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। সাদা ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট পরল। সাদা পোষাকেও বেশ উৎফুল্ল লাগে তার। ঠিক সাড়ে সাতটায় সে এসে পৌঁছল যোধপুর পার্কে। আশ্চর্য, আজ তাকে বাড়িটা খুঁজে পেতে ট্যাক্সি নিয়ে বেশ ঘুরতে হল খানিকক্ষণ।
পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে অজয় খান্ডেলকর বসবার ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। দিব্য ঢুকতেই তিনি সহাস্যে বললেন, একটা ভালো খবর আছে। ইমপোর্ট লাইসেন্সের সেই প্রবলেমটা সলভ করে ফেলেছি এর মধ্যেই। ফাইলটা আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালেই পাঠিয়ে দেবেন, কেমন?
দিব্য তখনও বসেনি, ফাইলটা হাতে নিয়ে সে ভাবল, তা হলে আর এখানে থাকার তো কোনও প্রয়োজন নেই, এখন চলে গেলেই তো হয়।
সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আমি আসি তাহলে?
অজয় ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, সে কী, বসুন! আমি তো আপনাকে সোস্যালি ইনভাইট করেছি। ভালোই হল, অফিসের কথাবার্তা আর বলতে হবে না, তাই না?
দিব্যর মনে হচ্ছে, সত্যিই সে একটা ফাঁদে এসে পড়েছে। অজয় খান্ডেলকরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারছে না। কী চান ইনি?
অজয় জিগ্যেস করলেন, আপনাকে কী ড্রিঙ্কস দেব?
অনেক অনুরোধেও দিব্য কোনওরকম মদ নিতে রাজি হল না। সে একটা নরম পানীয় নিয়ে অল্প-অল্প চুমুক দিতে লাগল।
অজয় জিগ্যেস করলেন, একটা কিছু গান দেওয়া যাক। আপনি গান ভালোবাসেন নিশ্চয়ই? কোন ধরনের গান? রবীন্দ্রসঙ্গীত?
দিব্য মাথা নাড়ল।
অজয় একটা ক্যাসেট রেকর্ডার কাছে নিয়ে এসে বললেন, আপনি কি জানেন আমার স্ত্রী এক সময় ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন?
দিব্য মাথা নেড়ে জানাল যে সে তা জানে না।
আমি ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আমার স্ত্রী, যখন তিনি আমার স্ত্রী ছিলেন না, তাঁর গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলুম। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে তিনি গান একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিছু তো একটা বলতে হবে, তাই দিব্য বলল, আপনারা তো অনেকদিন বাইরে ছিলেন।
হ্যাঁ সাত বছর। খুব দীর্ঘ সময় তাই না? কিন্তু বিদেশেও তো অনেকে গান-বাজনার চর্চা রাখে। বনানী ঘোষ রবীন্দ্রসংগীতের স্কুল চালান। আমরা যেখানে ছিলাম, তার কাছেই আলি আকবরের মিউজিক স্কুল। আমার স্ত্রী তবু গেল না।
দিব্য ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অজয় খান্ডেলকর শুধু স্ত্রীর প্রসঙ্গে কথা বলছেন। এই জন্যই তিনি দিব্যকে ডেকে এনেছেন।
অজয় ক্যাসেট রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন। নারী কণ্ঠের একটা গান শুরু হল। দিন যায়, যায় রে! টানা সুরের গান, গভীর বিষাদে ভরা। কণ্ঠস্বর খুব গভীর। গানটা যেন ওই গায়িকার একেবারে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে। দিব্যর কাছে এই কণ্ঠস্বর অচেনা।
দুজনে নিঃশব্দে গানটি শুনল। ওই একটা গান শেষ হওয়ার পরই অজয় যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলেন।
দিব্য জিগ্যেস করল, এটা কার গান?
হাসি রায়ের। আপনি নাম শুনেছেন?
না।
হাসি রায়ের ভালো নাম ছিল অনসূয়া। এখন তিনি আমার স্ত্রী। এই গানটা উনি গেয়েছেন চারদিন আগে। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর আমি ওঁর গলায় একটা পুরো গান শুনলাম। রাত্তিরবেলা, অনেক রাত্রি তখন, দুটো-আড়াইটে হবে ঘুম ভেঙে গেল, আমি দেখি, আমার স্ত্রী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, এই গানটা গাইতে-গাইতে তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আমাদের বিবাহিত জীবনে তাঁকে কোনওদিন কষ্ট পেতে দেখিনি, আমি তাঁকে সবরকম সুখে রাখতে চেয়েছি। বরং আমারই মনে একটা দুঃখ ছিল উনি গান ছেড়ে দিয়েছেন বলে!
কেন গান ছেড়ে দিয়েছিলেন?
জানি না। কোনওদিন তো বলেননি। সেদিন মাঝরাতে ওঁকে এই গানটা গাইতে শুনেই আমি ক্যাসেটটা চালিয়ে দিই। তারপর গান শেষ হল, উনি তবু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। দিন যায়, যায় রে। গানের কথাগুলো লক্ষ করেছেন? তা হলে কি ওঁর দিনগুলো এইরকম দুঃখেই কাটছে, যা আমি খবর রাখি না? আমি তখন হাসির কাছে গিয়ে আস্তে জিগ্যেস। করলাম, তোমার কীসের এত দুঃখ? আমি কি কিছু ভুল করেছি? উনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আমার বুকে মাথা রাখলেন। আমি তাঁর চুলে হাত বুলোত লাগলাম। তারপর একটু সামলে নিয়ে উনি বললেন, সত্যি আমার কোনও অভাব নেই, দুঃখ নেই। কিন্তু কদিন আগে একজন লোক এসে আমার মন খারাপ করে দিয়ে গেছে!
দিব্য সামনে ঝুঁকে পড়ে ব্যাকুলভাবে বললেন, মিঃ খান্ডেলকর, আমি…
অজয় তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আগে শেষ করে নিই! হাসির মুখে ওই কথা শুনে আমি স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলুম। জিগ্যেস করলুম, রাত্তিরবেলা একজন লোক এসেছিল? কে? হাসি বললেন, ঘটনাটা তোমাকে জানাতে চাইনি, ড্রিংক করে কেউ-কেউ মাঝে-মাঝে এরকম পাগলামি করে, পরেরদিন সেজন্য খুব লজ্জা পায়। এ নিয়ে বেশি রাগারাগি বা কোনওরকম অ্যাকশন নেওয়া উচিত নয়। দিব্য ছেলেটিকে দু-একদিন যা দেখেছি, এমনিতে খুব ভদ্র। সে রাত্তিরে এসে আমার সঙ্গে কোনওরকম অসভ্যতা করেনি, শুধু বারবার বলছিল, তোমার নাম মহাশ্বেতা! কেন ওরকম বলছিল? তারপর থেকেই আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমি কিছুতেই মনটা ঠিক করতে পারছি না। আমার কান্না এসে যাচ্ছে।
দিব্য মাথা নীচু করে বসে রইল।
অজয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কেন এসেছিলেন আমি জানি না। জানতে চাই না। কিন্তু আপনি আমার উপকারই করেছেন। আপনি হাসির গলা থেকে আবার গান বার করে এনেছেন। দাঁড়ান, হাসিকে ডাকি।
অজয় চট করে চলে গেলেন ভেতরে। দিব্য একলা বসে থেকে মরমে মরে যেতে লাগল। এখন কী করা উচিত, কী বলা উচিত, কিছুই সে বুঝতে পারছে না।
প্রায় পাঁচ মিনিট বাদেশ্ৰীমতী অনসূয়া খান্ডেলকর ঘরে ঢুকলেন একা। মুখখানা দেখে মনে হয় বিষাদ প্রতিমা। দিব্যর সামনে এসে বসলেন।
দিব্যর হাত-পা কাঁপছে। জীবনে সে কখনও এত নার্ভাস বোধ করেনি। কেন সে এখানে এল?
পরদিনই তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যাওয়া উচিত ছিল। মুখ তুলে দিব্য গভীর আবেগের সঙ্গে বলল, আমি দুঃখিত। সেদিনের ব্যবহার যদিও অমার্জনীয়, তবু আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইছি।
হাসি অস্ফুট স্বরে জিগ্যেস করল, আপনি কেন এসেছিলেন?
আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি কোনওদিন কারুর সঙ্গে এরকম…আমি নিজেই আমার ব্যবহারের মানে বুঝতে পারছি না! কেউ যেন আমাকে জোর করে টেনে এনেছিল।
মহাশ্বেতা কে? আপনি কেন বলেছিলেন, আমার নাম মহাশ্বেতা?
তাও আমি ঠিক জানি না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, আমি ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। কেন যে আপনাকে মহাশ্বেতা বললুম।
ওই নামে কেউ ছিল?
ছিল, অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে!
ওকে নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট ছিল বুকের মধ্যে? সেই কষ্টটা আপনি আমাকে দিয়ে গেলেন। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ওই নাম। কেন আমাকে মহাশ্বেতা বলেছিলেন, ভাবতে গেলেই কান্না পেয়ে যায়। সেই কান্না হঠাৎ একদিন গান হয়ে বেরিয়ে এল। আমি যেন একটা, কী বলব, যেন একটা সুখের ফানুসের মধ্যে ছিলুম, হঠাৎ কী করে ঢুকে পড়ল দুঃখ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অজয় বললেন, এজন্য দিব্যবাবুকে আমাদের দুজনেরই ধন্যবাদ জানানো উচিত। তাই না? হাসি, তুমি এবারে আমাদের একটা গান উপহার দাও! তানপুরাটা আনি?
হাসি আর একটা গান শুরু করল। চির সখা হে, ছেড়োনা! এ গানেও দুঃখের সুর। গান শুনতে-শুনতে দিব্যর চোখে জল এসে যাচ্ছে। কবে, কোথায় হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা! এখন তার মুখটাও আর দিব্যর মনে নেই। তবু সেই মহাশ্বেতার মন খারাপ কী করে যেন সুর হয়ে ঝরে-ঝরে পড়ছে হাসির কণ্ঠ দিয়ে। হাসি এখন সত্যিই মহাশ্বেতা!
হাসি গায়িকা হয়নি বটে কিন্তু সে সুখী জীবন পেয়েছে। কিংবা খুব সহজেই সুখটাকে মেনে নিয়েছে বলে সে শিল্পী হতে পারল না।
তিন
সেদিন এমন কিছু নেশা হয়নি দিব্যর যে পরেরদিন সে কথা মনে থাকবে না।
লজ্জিত হওয়ার চেয়েও সে বিস্মিত হয়েছিল অনেক বেশি। কেন সে অমনভাবে অনসূয়া খান্ডেলকরের কাছে ছুটে গিয়েছিল অত রাতে? এটা তো নিছক অন্যমনস্কতা নয়! এ তো পাগলামি। অনসূয়ার সঙ্গে তার অতি সামান্য আলাপ, ভদ্রমহিলার চেহারা সুন্দর, ব্যবহারও বেশ ভালো, সকলেই তাকে পছন্দ করে। দিব্যর ক্ষেত্রেও তার বেশি কিছু নয়, সে অনসূয়ার প্রেমে পড়েনি, তাকে নিয়ে সে কোনও স্বপ্নও দেখে না। তাহলে?
দিব্য বেশ ভয় পেয়ে গেল। তার মেজমামা এমনই হিংস্র উন্মাদ যে তাঁকে বছরের পর বছর একটা নার্সিং হোমে রাখতে হয়। দিব্যর মধ্যেও সেই পাগলামির বীজ ঢুকেছে নাকি?
দিব্য দু-তিনদিন খুব মনমরা হয়ে রইল। অফিসে গেল না। কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার কথা চিন্তা করেও যেতে সাহস হল না। সে চুপচাপ বাড়িতে শুয়ে কাটাল।
ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে কি বলে দিয়েছেন সেই রাত্রির ঘটনা? বলাটাই স্বাভাবিক।
দিব্য অজয় খান্ডেলকরের অধীনে কাজ করে না, তার অফিস আলাদা, কিন্তু তার অফিসের স্বার্থে তাকে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে হয়। তার অফিস থেকে মাঝে-মাঝেই পাটি দেওয়া হয়, অনসূয়া খান্ডেলকর সেখানে আসেন।
দিব্য বিষণ্ণভাবে ভাবল, হয়তো এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। অজয় খান্ডেলকর তার নামে অভিযোগ করলে দিব্যদের অফিসের জি. এম. আর দিব্যকে রাখবেন না। কারণ, অজয় খান্ডেলকরের মূল্য অনেক বেশি। যদিও দিব্যর নামে দুশ্চরিত্রতার অভিযোগ শুনলে জেনারেল ম্যানেজার প্রথমবার একেবারে হাঁ হয়ে যাবেন।
চেষ্টা করলে দিব্য একটা অন্য চাকরি পেয়ে যাবে। তার যোগ্যতা আছে। কিন্তু এই অফিসটা তার বেশ পছন্দ ছিল। চাকরি জীবনে মাইনে ছাড়াও পছন্দ মতন সহকর্মী পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার।
চারদিন পরে দিব্য আবার অফিসে গেল এবং কারুর মুখে কোনও ব্যাঁকা কথা শুনল না। কেউ কিছু জানে না। সবই আগের মতন স্বাভাবিক।
কিন্তু দিব্যর ব্যবহার অনেক আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সে মেপে-মেপে কথা বলে। যে কোনও জায়গায় যাওয়ার আগে সে ভেবে নেয় ঠিক জায়গায় যাচ্ছে তো? বাথরুম থেকে বেরুবার আগে অন্তত। তিনবার দেখে নেয় জামা-প্যান্ট ঠিক মতন পরা হয়েছে কি না!
শনিবার তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অশোক বাজপেয়ীর বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন ছিল, দিব্য কায়দা করে এড়িয়ে গেল। অশোকের বাড়িতে গেলেই খুব মদ্যপান হয়, অশোক খুব জোর করে। দিব্য এখন বেশ কিছুদিন মদ ছুঁতে চায় না। যথেষ্ট মদ খেলেও তার নেশা হয় না এই গর্ব ছিল, এক। সন্ধেবেলা সব উলটে গেল। এয়ারপোর্ট হোটল থেকে সে ছুটে গেল যোধপুর পার্ক, এটা মাতলামি পাগলামি?
মহাশ্বেতা! নামটা একেবারে কাল্পনিক নয়। কিন্তু কতদিন আগে হারিয়ে গেছে সেই মহাশ্বেতা। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঘাটশিলায়, তখন দিব্যর বয়েস একুশ-বাইশ হবে। তার গায়ে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গন্ধ।
মহাশ্বেতারাও বেড়াতে এসেছিল। মহাশ্বেতাদের খুব বড় পরিবার! এক দঙ্গল লোক! মহাশ্বেতার বয়েস সতেরা-আঠারো হবে। তার বয়েসী আরও দুটি মেয়ে ছিল ওদের দলে। তাদের নাম মনে নেই। পাশাপাশি বাড়িতে থাকা তাই আলাপ পরিচয় হবেই। তারপর কিছু হাসি-ঠাট্টা, একসঙ্গে বেড়ানো, কোনও লোকজনের দিকে গাঢ় চোখে তাকান, এর বেশি আর কিছু না।
দিব্য তখন খুব লাজুক ছিল। অন্য অনেক ছেলে যেমন কথার পিঠে চালাক-চালাক কথা বলে, সে ক্ষমতা তার একেবারেই ছিল না। মহাশ্বেতার সঙ্গের অন্য দুটি মেয়ে বরং বেশ স্মার্ট। মহাশ্বেতা একটু চুপচাপ ধরনের।
ওই তিনজনের কোনও একজনের সঙ্গেই দিব্যর প্রেম হয়নি, মনে রাখবার মতন কিছু ঘটেনি।
শুধু একটা বিকেলে, সেদিন বোধহয় ধারাগিরির দিকে সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। একসঙ্গে, মহাশ্বেতা তাকে বলেছিল, আমার মাঝে-মাঝে ভীষণ মন খারাপ হয়! কোনও কারণ নেই, এমনি-এমনি, কেন যে হয় বুঝতে পারি না। কী করে মন খারাপ ভালো করা যায় বলতে পারেন?
অতিরিক্ত লাজুক লোকরা অনেক সময় রূঢ় হয়। সেই রকমভাবেই দিব্য বলেছিল, আমি কী করে জানব, আমি কী ডাক্তার?
মহাশ্বেতার মুখখানা ডিমের মতন। তার মুখের রঙ চাপা জ্যোৎস্নার মতন। ভুরু দুটি খুব গভীর। তখনও তার ভুরু প্লাক করার বয়েস হয়নি। খুব একটা সাজগোজের দিকেও মনোযোগ ছিল না।
গভীর ভুরু দুটি তুলে আহত বিস্ময়ের সঙ্গে সে বলেছিল, বাঃ শুধু ডাক্তাররাই বুঝি মন খারাপের কথা বোঝে? আর কেউ বোঝে না? এই যে বিকেলের আলো কমে আসছে, একটা দিন চলে যাচ্ছে, আকাশটা কী রকম হারিয়ে যাচ্ছে, এই সময়টায় আমার বেশি মন খারাপ হয়। আপনার হয় না?
দিব্য বলেছিল, না।
মহাশ্বেতা বলেছিল, আপনি বুঝি খুব গোঁয়ার? শুনেছি গোঁয়ার লোকদের মন খারাপ হয় না। আপনার সত্যিই কখনও হয় না?
দিব্য আবার বোকার মতন বলেছিল, না!
মহাশ্বেতা বেশ কয়েক মুহূর্ত দিব্যর চোখের দিকে চেয়ে থেকে খুব নরম ভাবে বলেছিল, ও এই সব মানুষদের আমার ভয় করে।
তারপর সে আস্তে-আস্তে একা হেঁটে গিয়েছিল জঙ্গলের দিকে।
লাজুক দিব্য তখন এইটুকু শুধু বুঝেছিল যে মহাশ্বেতাকে সে ভুল কথা বলেছে। মহাশ্বেতা মনে একটু আঘাত পেয়েছে। কিন্তু ঠিক কী কথা তাকে বলা উচিত ছিল তা দিব্যর মনে পড়েনি।
মহাশ্বেতা যখন একলা চলে গেল তখনও সে একটা পাথরের ওপরেই বসে রইল, ওর সঙ্গে গেল না। মহাশ্বেতার সঙ্গে ঠিক কোন কথা বলতে হবে, সেটাই যে সে জানে না।
মহাশ্বেতার সঙ্গে দিব্যর আর কোনওদিন দেখা হয়নি। দিব্য যদি চালু ছেলে হত, তাহলে মহাশ্বেতাকে কলকাতায় ঠিকই খুঁজে বার করত, যোগাযোগ রাখত। কিন্তু দিব্য তখন ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝে-মাঝে ধারাগিরির কাছে সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ত। মহাশ্বেতাকে কী উত্তর দেওয়া উচিত ছিল?
বছর দেড়েক বাদে দিব্যর ছোট বোন একদিন বলল, দাদা, ঘাটশিয়াল সেই যে মহাশ্বেতা বলে একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মনে আছে! ইস কী কাণ্ড!
মহাশ্বেতার লম্বাটে মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল দিব্যর। হ্যাঁ তাকে মনে আছে, অন্য কোনও কারণে নয়, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে।
দিব্য জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তার?
রিনি বলল, আজ কাগজে দ্যাখোনি? সে আত্মহত্যা করেছে। কাগজে লিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মহাশ্বেতা সেনগুপ্ত শ্লিপিং পিল খেয়েছে, তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।
তৎক্ষণাৎ দিব্যর মনে পড়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতার প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা। দিব্যর বলা উচিত ছিল, আমাকে তোমার মন খারাপের খানিকটা ভাগ দাও। গোঁয়ার লোকদের শিখিয়ে দাও, কী করে মন খারাপের ভাগ নিতে হয়!
সেইদিন ধারাগিরির কাছে বিকেলে ঠিকঠিকভাবে মহাশ্বেতাকে এই কথাটা বলতে পারলে হয়তো সে আত্মহত্যা করত না। হয়তো এই প্রশ্ন সে আরও কারু-কারুর কাছে করেছে, কেউ সঠিক উত্তর দেয়নি!
তারপর কতদিন কেটে গেছে, একেবারে হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা। দিব্য তার বুকের মধ্যে কোনও অপরাধবোধ পুষে রাখেনি, কেনই বা রাখবে?
অনসূয়ার সঙ্গে তো মহাশ্বেতার কোনও মিল নেই! যতদূর সে জানে, অনসূয়া খান্ডেলকরের জীবন খুব সুখী আর পরিতৃপ্ত। দিব্য তার কাছে কেন গিয়ে বলবে…। না, দিব্য কিছুতেই তার নিজের ব্যবহারের যুক্তি খুঁজে পায় না।
সোমবার দিব্য অফিসে গিয়েই শুনল যে অজয় খান্ডেলকর তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
জেনারেল ম্যানেজার বললেন, শোনো দিব্য মিঃ খান্ডেলকর তোমায় বেশ পছন্দ করেন, আমি আগেও লক্ষ্য করেছি। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মিঃ খান্ডেলকরকে আমরা উইথ। ফ্যামিলি কাশ্মীরে একটা গুড ট্রিটমেন্ট দিতে চাই। ওখানে আমরা একটা সেমিনারের আয়োজন করব। সেটা হবে প্রধানত ওঁরই জন্য। তোমাকে খুব কায়দা করে কথাটা পাড়তে হবে। উনি যেন বুঝতে না পারেন যে ওঁর জন্য স্পেশাল কিছু করা হচ্ছে। তুমি ওঁর কাছ থেকে একটা ডেট নিয়ে এসো। তুমি এটা পারবে, আমি জানি।
দিব্য মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।
দিব্য অবশ্য মনে-মনে ঠিকই বুঝেছে, শুধু তাকে আলাদা করে ডাকার মানেটা কী! অজয় খান্ডেলকর খুব কড়া ধরনের নীতিবাগিশ মানুষ। বাইরে অত্যন্ত ভদ্র, কিন্তু নিজের বিশ্বাসে সব সময় স্থির থাকেন। এইবারে তিনি দিব্যকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়বেন।
দিব্যকে হয়তো আজই চাকরিটা ছাড়তে হবে, তবু সে ঠিক করল তার যাওয়া উচিত। নইলে ছিচকে অপরাধীর মতন মনে হবে নিজেকে। অজয় খান্ডেলকর যা খুশি বলার পর সে ক্ষমা চাইবে।
অজয় খান্ডেলকর বসেন চৌরঙ্গি অঞ্চলের উঁচু বাড়ির ষোলতলায়। তাঁর ঘর থেকে সম্পূর্ণ ময়দান ও তার একপ্রান্তে গঙ্গার বাঁক দেখতে পাওয়া যায়। খিদিরপুরের জাহাজগুলো দেখা যায় স্পষ্ট।
অজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দিব্যর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, আসুন-আসুন। ওঃ, আজ রোদ বড় চড়া, আসতে আপনার কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই। একটা খুব জরুরি পয়েন্ট ক্লিয়ার করার কথা, সেই জন্যই আপনাকে ডেকেছি।
সত্যিই অফিস সংক্রান্ত একটা জরুরি ব্যাপার। অজয় কোনওরকম ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুললেন না। একটা ইমপোর্ট লাইসেন্সের ব্যাপারে দিল্লি থেকে আপত্তি জানিয়েছে, তবু তাড়াতাড়ি তার উত্তর পাঠাতে হবে। প্রায় সওয়া ঘণ্টা ধরে দুজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি আলোচনা করল।
তখনও কাজ বাকি থেকে গেল খানিকটা। কিন্তু অজয়কে বেরুতে হবে, তাঁর একটা জরুরি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে অজয় বললেন, আমি দুঃখিত, দিব্যবাবু, কাজটা শেষ করা গেল না। অথচ কালই উত্তর পাঠানো দরকার।
দিব্য বলল, আমি কাল সকাল ঠিক সাড়ে নটায় আবার আসতে পারি।
অজয় হুঁ, বলে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগলেন।
দিব্য এই সুযোগে কাশ্মীরের প্রস্তাবটা পেড়ে ফেলল। অজয় সে সম্পর্কে বেশি আগ্রহ প্রকাশনা করে বললেন, ওসব পরে ভেবে দেখা যাবে। আপনি আজ সন্ধেবেলা বিশেষ কিছু করবেন? ফ্রি আছেন?
দিব্য একটু অবাক হয়ে বলল, না তেমন কিছু নেই। কেন বলুন তো!
অজয় হেসে বললেন, আমি ভাবছিলুম, আপনি যদি আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে আসতে পারেন। কাজটাও শেষ করা যায়, খানিকটা গল্পগুজবও করা যায়। অফিসের সময়টা তো আমরা সবাই যন্ত্রের মতন, তাই না? যেন আমাদের কোনও সামাজিক পরিচয় নেই।
দিব্য চুপ করে চেয়ে রইল।
কোনও অসুবিধে আছে?
না।
তাহলে চলে আসুন। আমার বাড়ি চেনেন তো! এই সাড়ে সাতটা নাগাদ! হ্যাঁ, আমাদের ওখানেই খেয়ে নেবেন! তা হলে ওই কথা রইল?
দিব্য একবার জানলা দিয়ে ময়দানের দিকে তাকাল। এত উঁচু থেকে সব কিছুই সুন্দর দেখায়। এখান থেকে আত্মহত্যা করা কত সোজা। একটুও ভয় করবে না।
বাইরে বেরিয়ে এসে দিব্যর মনে হল, অজয় খান্ডেলকর কি একটা ফাঁদ পেতে তার মধ্যে। দিব্যকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন? কিন্তু তাঁর ব্যবহারে কোনওরকম ধূর্ততার চিহ্ন নেই। তাঁর এই যে ভালোমানুষী ব্যবহার, এর সবটাই অভিনয় হতে পারে? কিন্তু অজয় খান্ডেলকর অফিসের কাজে কোনওদিন কারুকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন, এরকম শোনাই যায় না।
তবে কি সমস্ত ব্যাপারটাই স্বপ্ন? সেদিন রাতে দিব্য যায়নি যোধপুর পার্কে। কিন্তু তার মানি ব্যাগ, ঘড়ি খোয়া গিয়েছিল…
অফিস একটু ছুঁয়েই বাড়ি চলে এল দিব্য। তারপর বেশ খানিকক্ষণ ঘুমলো। ঘুম থেকে উঠে খুব ভালোভাবে স্নান করল। ঘুম আর স্নান, এই দুটোতেই মন বেশ স্নিগ্ধ থাকে অনেকক্ষণ। মনের
এইরকম অবস্থায় নিজে বেশি কথা না বলে অন্যের কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। সাদা ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট পরল। সাদা পোষাকেও বেশ উৎফুল্ল লাগে তার। ঠিক সাড়ে সাতটায় সে এসে পৌঁছল যোধপুর পার্কে। আশ্চর্য, আজ তাকে বাড়িটা খুঁজে পেতে ট্যাক্সি নিয়ে বেশ ঘুরতে হল খানিকক্ষণ।
পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে অজয় খান্ডেলকর বসবার ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। দিব্য ঢুকতেই তিনি সহাস্যে বললেন, একটা ভালো খবর আছে। ইমপোর্ট লাইসেন্সের সেই প্রবলেমটা সলভ করে ফেলেছি এর মধ্যেই। ফাইলটা আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালেই পাঠিয়ে দেবেন, কেমন?
দিব্য তখনও বসেনি, ফাইলটা হাতে নিয়ে সে ভাবল, তা হলে আর এখানে থাকার তো কোনও প্রয়োজন নেই, এখন চলে গেলেই তো হয়।
সে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আমি আসি তাহলে?
অজয় ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, সে কী, বসুন! আমি তো আপনাকে সোস্যালি ইনভাইট করেছি। ভালোই হল, অফিসের কথাবার্তা আর বলতে হবে না, তাই না?
দিব্যর মনে হচ্ছে, সত্যিই সে একটা ফাঁদে এসে পড়েছে। অজয় খান্ডেলকরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে সে পাল্লা দিতে পারছে না। কী চান ইনি?
অজয় জিগ্যেস করলেন, আপনাকে কী ড্রিঙ্কস দেব?
অনেক অনুরোধেও দিব্য কোনওরকম মদ নিতে রাজি হল না। সে একটা নরম পানীয় নিয়ে অল্প-অল্প চুমুক দিতে লাগল।
অজয় জিগ্যেস করলেন, একটা কিছু গান দেওয়া যাক। আপনি গান ভালোবাসেন নিশ্চয়ই? কোন ধরনের গান? রবীন্দ্রসঙ্গীত?
দিব্য মাথা নাড়ল।
অজয় একটা ক্যাসেট রেকর্ডার কাছে নিয়ে এসে বললেন, আপনি কি জানেন আমার স্ত্রী এক সময় ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন?
দিব্য মাথা নেড়ে জানাল যে সে তা জানে না।
আমি ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আমার স্ত্রী, যখন তিনি আমার স্ত্রী ছিলেন না, তাঁর গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলুম। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে তিনি গান একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিছু তো একটা বলতে হবে, তাই দিব্য বলল, আপনারা তো অনেকদিন বাইরে ছিলেন।
হ্যাঁ সাত বছর। খুব দীর্ঘ সময় তাই না? কিন্তু বিদেশেও তো অনেকে গান-বাজনার চর্চা রাখে। বনানী ঘোষ রবীন্দ্রসংগীতের স্কুল চালান। আমরা যেখানে ছিলাম, তার কাছেই আলি আকবরের মিউজিক স্কুল। আমার স্ত্রী তবু গেল না।
দিব্য ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অজয় খান্ডেলকর শুধু স্ত্রীর প্রসঙ্গে কথা বলছেন। এই জন্যই তিনি দিব্যকে ডেকে এনেছেন।
অজয় ক্যাসেট রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন। নারী কণ্ঠের একটা গান শুরু হল। দিন যায়, যায় রে! টানা সুরের গান, গভীর বিষাদে ভরা। কণ্ঠস্বর খুব গভীর। গানটা যেন ওই গায়িকার একেবারে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে। দিব্যর কাছে এই কণ্ঠস্বর অচেনা।
দুজনে নিঃশব্দে গানটি শুনল। ওই একটা গান শেষ হওয়ার পরই অজয় যন্ত্রটা বন্ধ করে দিলেন।
দিব্য জিগ্যেস করল, এটা কার গান?
হাসি রায়ের। আপনি নাম শুনেছেন?
না।
হাসি রায়ের ভালো নাম ছিল অনসূয়া। এখন তিনি আমার স্ত্রী। এই গানটা উনি গেয়েছেন চারদিন আগে। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর আমি ওঁর গলায় একটা পুরো গান শুনলাম। রাত্তিরবেলা, অনেক রাত্রি তখন, দুটো-আড়াইটে হবে ঘুম ভেঙে গেল, আমি দেখি, আমার স্ত্রী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, এই গানটা গাইতে-গাইতে তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আমাদের বিবাহিত জীবনে তাঁকে কোনওদিন কষ্ট পেতে দেখিনি, আমি তাঁকে সবরকম সুখে রাখতে চেয়েছি। বরং আমারই মনে একটা দুঃখ ছিল উনি গান ছেড়ে দিয়েছেন বলে!
কেন গান ছেড়ে দিয়েছিলেন?
জানি না। কোনওদিন তো বলেননি। সেদিন মাঝরাতে ওঁকে এই গানটা গাইতে শুনেই আমি ক্যাসেটটা চালিয়ে দিই। তারপর গান শেষ হল, উনি তবু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। দিন যায়, যায় রে। গানের কথাগুলো লক্ষ করেছেন? তা হলে কি ওঁর দিনগুলো এইরকম দুঃখেই কাটছে, যা আমি খবর রাখি না? আমি তখন হাসির কাছে গিয়ে আস্তে জিগ্যেস। করলাম, তোমার কীসের এত দুঃখ? আমি কি কিছু ভুল করেছি? উনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আমার বুকে মাথা রাখলেন। আমি তাঁর চুলে হাত বুলোত লাগলাম। তারপর একটু সামলে নিয়ে উনি বললেন, সত্যি আমার কোনও অভাব নেই, দুঃখ নেই। কিন্তু কদিন আগে একজন লোক এসে আমার মন খারাপ করে দিয়ে গেছে!
দিব্য সামনে ঝুঁকে পড়ে ব্যাকুলভাবে বললেন, মিঃ খান্ডেলকর, আমি…
অজয় তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়ান আমি আগে শেষ করে নিই! হাসির মুখে ওই কথা শুনে আমি স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলুম। জিগ্যেস করলুম, রাত্তিরবেলা একজন লোক এসেছিল? কে? হাসি বললেন, ঘটনাটা তোমাকে জানাতে চাইনি, ড্রিংক করে কেউ-কেউ মাঝে-মাঝে এরকম পাগলামি করে, পরেরদিন সেজন্য খুব লজ্জা পায়। এ নিয়ে বেশি রাগারাগি বা কোনওরকম অ্যাকশন নেওয়া উচিত নয়। দিব্য ছেলেটিকে দু-একদিন যা দেখেছি, এমনিতে খুব ভদ্র। সে রাত্তিরে এসে আমার সঙ্গে কোনওরকম অসভ্যতা করেনি, শুধু বারবার বলছিল, তোমার নাম মহাশ্বেতা! কেন ওরকম বলছিল? তারপর থেকেই আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমি কিছুতেই মনটা ঠিক করতে পারছি না। আমার কান্না এসে যাচ্ছে।
দিব্য মাথা নীচু করে বসে রইল।
অজয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কেন এসেছিলেন আমি জানি না। জানতে চাই না। কিন্তু আপনি আমার উপকারই করেছেন। আপনি হাসির গলা থেকে আবার গান বার করে এনেছেন। দাঁড়ান, হাসিকে ডাকি।
অজয় চট করে চলে গেলেন ভেতরে। দিব্য একলা বসে থেকে মরমে মরে যেতে লাগল। এখন কী করা উচিত, কী বলা উচিত, কিছুই সে বুঝতে পারছে না।
প্রায় পাঁচ মিনিট বাদেশ্ৰীমতী অনসূয়া খান্ডেলকর ঘরে ঢুকলেন একা। মুখখানা দেখে মনে হয় বিষাদ প্রতিমা। দিব্যর সামনে এসে বসলেন।
দিব্যর হাত-পা কাঁপছে। জীবনে সে কখনও এত নার্ভাস বোধ করেনি। কেন সে এখানে এল?
পরদিনই তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যাওয়া উচিত ছিল। মুখ তুলে দিব্য গভীর আবেগের সঙ্গে বলল, আমি দুঃখিত। সেদিনের ব্যবহার যদিও অমার্জনীয়, তবু আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইছি।
হাসি অস্ফুট স্বরে জিগ্যেস করল, আপনি কেন এসেছিলেন?
আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, আমি কোনওদিন কারুর সঙ্গে এরকম…আমি নিজেই আমার ব্যবহারের মানে বুঝতে পারছি না! কেউ যেন আমাকে জোর করে টেনে এনেছিল।
মহাশ্বেতা কে? আপনি কেন বলেছিলেন, আমার নাম মহাশ্বেতা?
তাও আমি ঠিক জানি না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, আমি ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। কেন যে আপনাকে মহাশ্বেতা বললুম।
ওই নামে কেউ ছিল?
ছিল, অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে!
ওকে নিয়ে আপনার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট ছিল বুকের মধ্যে? সেই কষ্টটা আপনি আমাকে দিয়ে গেলেন। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ওই নাম। কেন আমাকে মহাশ্বেতা বলেছিলেন, ভাবতে গেলেই কান্না পেয়ে যায়। সেই কান্না হঠাৎ একদিন গান হয়ে বেরিয়ে এল। আমি যেন একটা, কী বলব, যেন একটা সুখের ফানুসের মধ্যে ছিলুম, হঠাৎ কী করে ঢুকে পড়ল দুঃখ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অজয় বললেন, এজন্য দিব্যবাবুকে আমাদের দুজনেরই ধন্যবাদ জানানো উচিত। তাই না? হাসি, তুমি এবারে আমাদের একটা গান উপহার দাও! তানপুরাটা আনি?
হাসি আর একটা গান শুরু করল। চির সখা হে, ছেড়োনা! এ গানেও দুঃখের সুর। গান শুনতে-শুনতে দিব্যর চোখে জল এসে যাচ্ছে। কবে, কোথায় হারিয়ে গেছে মহাশ্বেতা! এখন তার মুখটাও আর দিব্যর মনে নেই। তবু সেই মহাশ্বেতার মন খারাপ কী করে যেন সুর হয়ে ঝরে-ঝরে পড়ছে হাসির কণ্ঠ দিয়ে। হাসি এখন সত্যিই মহাশ্বেতা!
সমাপ্ত---------------------------------------।
COMMENTS