সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলীক নগরী"------ মধু'র ভূবণ ।

SHARE:

bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য ছোট গল্প 

                                "অলীক নগরী"



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প,  "অলীক নগরী"------ মধু'র ভূবণ ।






শেষরাত্রি, ভোর আর সকালের মধ্যে ঠিক কতটা যে পার্থক্য তা অনুভব করেছি জীবনে কদিন? ভোর খুব সুন্দর, তার স্মৃতি আছে, কবিতায় বর্ণনা করতে পারি, কিন্তু অধিকাংশ দিনই ঘুম ভাঙে কটকটে রোদ ওঠার পর।

খবরের কাগজ আসে সাতটা দশে, সেটা সকাল। তার একঘণ্টা আগে ভোর। তা বলে পৌনে পাঁচটা নিশ্চয়ই শেষরাত্রি; এইরকম ধারণা ছিল। হঠাৎ মধ্য-সেপ্টেম্বরে একদিন অসময়ে জেগে উঠলুম। সাধারণ চোখ মেলে পাশ ফেরা নয়। চোখ একেবারে ঘুমশূন্য, কে যেন আমাকে ডেকে বলল, বাইরে এসো!

পাজামা ছেড়ে দ্রুত জাঙ্গিয়া, প্যান্ট, শার্ট পরে, রবারের চপ্পল পায়ে গলিয়ে ব্যস্তভাবে নেমে এলুম। সিঁড়ি দিয়ে। যেন আমার কোনও জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

পুবের আকাশে সূর্য নেই, কিন্তু লেবু-রঙের আলো ফুটে উঠেছে। তা হলে এটা শেষ রাত্রি, না ভোর? ব্রাহ্মমুহূর্ত বলে একটা গাল-ভরা শব্দ ছেলেবেলায় শুনেছি।

এরই মধ্যে রাস্তায় বিভিন্ন বয়েসি পুরুষ বেরিয়েছে, স্ত্রীলোকেরা আছে, টাটকা সবজিভরতি ঠেলাগাড়ি ছুটছে প্রাণপণে। আমি না জাগলেও প্রত্যেক দিন এই সময়ের মধ্যেই শহর জেগে ওঠে? এত মানুষ! মন্দিরের মতন কাঁসর বাজিয়ে একটা ট্রাম ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমারই জন্য এই ট্রামটা এইমাত্র এখানে এল, তাতে সন্দেহ কী? উঠে পড়লুম।

আমার পকেটে গত দিনের দু-খানা দু-টাকার লাল নোট। নতুন টাকা পয়সা নেওয়ার কথা মনে পড়েনি। কন্ডাক্টর আসতেই তার দিকে বাড়িয়ে দিলুম একটি নোট, সে জিগ্যেস করল, পার্ক স্ট্রিট?

কেন নিজের থেকে বলল ওই কথা? আমাকে অন্য কোনও মানুষ বলে ভুল করেছে? তা হলে আমাকে পার্ক স্ট্রিটেই যেতে হবে। কন্ডাক্টরটির গালে মেহেদি লাগানো কমলা রঙের দাড়ি।

এত সকালে কে পার্ক স্ট্রিট যায়?

ট্রামটা এত জোর ছুটছে যেন মাঝখানে অন্য কোথাও থামবে না। এই সময়ে ফুটপাতে অনেক ফুল পড়ে থাকে।

পার্কসার্কাসের মোড়ে নেমে আমি হাঁটতে লাগলুম পুরোনো কবরখানার পাশ দিয়ে। আমি ছাড়া আর কোনও যাত্রী এখানে নামল না কেন? ফুটপাথে লাগানো হয়েছে নতুন কয়েকটা ফুলের। গাছ। একটি ভিখিরি পরিবার এরই মধ্যে কাঠের আগুনে রান্না চাপিয়েছে। খিচুড়ির গন্ধ। এত ভোরে ওরা খায়? একটি কিশোরী এক গোছা জ্যাকোরান্ডা ফুল ছিঁড়ে এনে দিয়ে দিল সেই ফুটন্ত খিচুড়ির মধ্যে। তার মা খলখল করে হেসে উঠল।

কেমন স্বাদ হয় ওই খিচুড়ির? ওর মধ্যে আরও কী কী দেয়? ভোরবেলা কবরখানার পাশের জীবন্ত মানুষরা যে এমন আনন্দে থাকে, তা তো জানতুম না!

এ পাশের ফুটপাথ দিয়ে একজন দীর্ঘকায় কালো রঙের লোক একটা সাদা রঙের লোমশ কুকুর নিয়ে যাচ্ছে চেন বেঁধে, জার্মান স্পিৎস। অন্যদিকে একজন গাউন পরা মহিলা টান-টান করে ধরে রেখেছে একটা চকচকে কালো রঙের কুকুর, ল্যাব্রাডর না, ককার স্প্যানিয়েল? দু-জাতের কুকুর পরস্পরকে সহ্য করতে পারে না। তারা ফুঁসে-ফুসে ডেকে উঠছে, মহিলা ও পুরুষটিও। রাস্তার দু-পাশ থেকে চোখাচোখি করছে এক এক বার। এই স্নিগ্ধ ভোরেও তাদের চোখে ঝলসে উঠছে ক্রোধ।

আমার পাশ দিয়ে চারজন সাপুড়ে গেরুয়া কাপড় দিয়ে বাঁধা বেতের ঝুড়ি ঝুলিয়ে চলে গেল। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি আরও চারজন, তাদের মধ্যে দু-জন কিশোর প্রায়। এত সাপুড়ে একসঙ্গে? সত্যিই এরা সাপুড়ে? ভোরবেলা সাপুড়েদের মিছিল? সারারাত এরা কোথায় থাকে?

কিছু-কিছু মানুষ সটান ঘুমিয়ে আছে ফুটপাথের ওপর। তারা সবাই ভবঘুরে বলে মনে হয় না। একটি দোকানের সিঁড়িতে পেছন ফিরে শুয়ে আছে একজন, তার জুতোজোড়া বেশ দামি মনে হয়।

শুধু কিছু কাক ডাকছে, আর কোনও পাখির স্বর শুনতে পাচ্ছি না।

একটি গাছতলায় ন্যাকড়া পেতে, তার ওপর একটা ছোট বাক্স রেখে বেশ পরিপাটিভাবে বসেছে একজন নাপিত। আমাকে দেখে সে মুচকি হেসে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি নিজে দাড়ি কামাই। রাস্তার নাপিতের কাছে উবু হয়ে বসে গালটা বাড়িয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই লোকটা পার্ক স্ট্রিটেও খদ্দের পায়?

লোকটিকে অগ্রাহ্য করে চলে যাচ্ছিলুম, তবু সে আবার ডাকল। যেন সে আমাকে কোনও গোপন কথা বলতে চায়। সে আঙুল তুলে গাছের ওপরটা দেখিয়ে বলল, একটা হনুমান! এটা অশথ গাছ। ডগার দিকে সত্যিই একটা হনুমান বসে আছে, তার গলায় একটা হলুদ রঙের কলার। সে একটা ডাল দোলাচ্ছে।

আমিও নাপিতটির সঙ্গে হাসি বদল করলুম। এটা একটা দেখার মতন দৃশ্যই বটে। হঠাৎ হনুমানটি তরতর করে নেমে এল গাছ থেকে। আমি একটু ভয় পেয়ে দেয়াল সেঁটে দাঁড়ালুম। হনুমানটি ধীরে-সুস্থেরাস্তা পার হতে গিয়ে মাঝখানে ট্রাফিক পুলিশের জায়গায়। একবার দাঁড়াল। এদিক-ওদিক চেয়ে খুব জোরে ছুট লাগাল, এখন কী তীব্র তার গতি, লাফাতে লাফাতে ঢুকে গেল একটা গলির মধ্যে।

নাপিতটি পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে বলল, দেশলাই আছে, স্যার?

আমি লাইটারটি তার হাতে না দিয়ে মুখের সামনে জ্বেলে দিলুম কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে। সেই ধোঁয়ার গন্ধে আমার গলাটা আনচান করলেও চা খাওয়ার আগে আমি ধূমপান করি না।

অবিকল যেন আমার মনের কথাটি বুঝতে পেরেই সে বলল, আর একটু এগিয়ে দেখুন, চা পাবেন।

তার কথার সুর শুনে মনে হয়, যেন সে আমার বাবা-ঠাকুরদাকেও চেনে!

কালো কুকুর সমেত গাউন পরা মহিলাটি তাড়াতাড়িতে ব্রা না পরেই বেরিয়েছে। এরকম তো হতেই পারে। ভোরবেলা কে আর সাজগোজ করে। কিন্তু মহিলাটির ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক। একটু ঝুঁকলেই তার বর্তুল স্তনদ্বয় দোলে। এখন রাঙা আলোয় তার মুখখানা রক্তিম। কালো, লম্বা লোকটিও দাঁড়িয়ে পড়ছে উলটোদিকের ফুটপাথে, হিরের মতন তার চোখ দুটো জ্বলছে।

একটু দূরে, ফুলছাপ শাড়ি-পরা একটি আদিবাসী রমণী চাপাকলে পোড়া কয়লা ধুচ্ছে। ঊরু

পর্যন্ত ভিজে গেছে তার শাড়ি। সে আপন মনে কয়লা ধুয়েই চলেছে। ওই কয়লায় সে কপয়সা পাবে? লোকে বলে, পার্ক স্ট্রিটে নাকি কোটি-কোটি টাকা রোজ ওড়ে?

এখন এখানে টাকা পয়সার কোনও গন্ধ নেই।

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মোড়টার কাছে গোল হয়ে বসেছে সেই সাপুড়েরা। গেরুয়া কাপড়ে জড়ানো তাদের বাঁশিগুলো খুলছে। এই ভোরে এখানে এত সাপুড়ে বসেছে কেন?

আমার মতন আরও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে পড়ে শুনছে তাদের বাঁশি। একজন পাঠান, তার গায়ের জামাটা হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা। অবশ্য সে সত্যিই পাঠান কি না তা আমার জানার কথা নয়। তবে ওই রকমই মনে হয়। একজন প্রৌঢ় সাহেব, সম্ভবত অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান, একজন লুঙ্গিপরা মুসলমান, তার মাথায় একটা ডিম ভরতি ঝুড়ি।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ানটি বিড়বিড় করে বলল, ওয়েইট আ মিনিট। দে ল ক্যাচ আ স্নেক।

এই সাহেবটি প্রত্যেক ভোরবেলা এখানে সাপ ধরা দেখতে আসে নাকি?

উলটোদিকে একটা বাচ্চাদের পার্ক। বাগানটিকে ঝোপ জঙ্গলও বলা যায়। ওই বাগানে সাপ আছে নাকি? খুব খারাপ কথা! সক্কালবেলা আমার সাপ দেখার একটুও ইচ্ছে নেই।

সাপুড়েদের বাঁশির শব্দ ও হাতের ভঙ্গিতে আমারও মাথা দুলছিল। সাপধরা দেখার জন্য আমি আর অপেক্ষা করতে চাইলুম না।

পেট্রল পাম্পের ভেতর থেকে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ। শিশুটিকে দেখা যাচ্ছে না। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাশ দিয়ে ধীর মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে একটি মোষ, চকচক করছে তার কালোগা। তার শিং দুটো সাদা রং করা। ওই রংটুকু না থাকলে মনে হত, সে এইমাত্র কোনও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে।

একটি দুটি গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে।

ছোট একটা মরিস মাইনর গাড়ি এসে থামল ফুটপাথ ঘেঁষে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক সম্ভ্রান্ত প্রৌঢ় নামলেন সেই গাড়ি থেকে, তার মুখ নাক অনেকটা অহীন্দ্র চৌধুরীর মতন। ধুতির কোঁচটা হাতে নিয়ে তিনি সাপুড়েদের বললেন, বাজাও, ভালো করে বাজাও!

যেন তিনি বিলায়েত খাঁ-র সেতার বাজনা উপভোগ করতে এসেছেন।

পাঠানটি অকস্মাৎ মোষটির দিকে তাকিয়েই দৌড়তে শুরু করল। কিন্তু সে মোষটিকে ধরতে গেল না, সে মিলিয়ে গেল উলটোদিকে।

ডিমওয়ালাটি আমার কাছে, এসে বলল, বাবু, দেশলাই আছে?

এক সকালে পরপর নাপিত ও ডিমওয়ালা একই সুরে আমার কাছে আগুন চাইছে কেন?

আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থামলুম নিলামের দোকানটার সামনে। লোহার গেট টানা,। গেটের ওপাশে সিঁড়ির ওপরে একটা ব্রোঞ্জের বুদ্ধের মুণ্ডু। ভেতরে না রেখে এই মূর্তিটা সিঁড়ির ওপরে বসানোর মানে কী? প্রতিদিন দোকান খোলার সময় এটাকে সরাতে হয়। দোকানদাররা কি বুদ্ধকে পাহারাদার হিসেবে রেখে যায়?

একটা নীল রঙের বেলুন উড়তে উড়তে আসছে। নিঃসঙ্গ, দূরের যাত্রীর মতন। আজকের আকাশ মেঘলা। কেন যেন আমার ধারণা ছিল, প্রত্যেকদিনই ভোরের সময় আকাশনীল থাকে। ওই বেলুনটা ছাড়া আর কোনও নীলের চিহ্নমাত্র নেই। কিছু মেঘ এখন সোনালি, কিছু বেশ ধূপের গন্ধ দেওয়া, নর্তকীর চুলের মতন। ঈশান কোণ কোন দিকে?

লম্বা, কালো লোকটি এবং গাউন পরা মহিলাটি এখন দুই কুকুর নিয়ে এক ফুটপাথে। দুটো কুকুরই গজরাচ্ছে। কুকুরে কুকুরের মাংস খায় না, আলাদা জাতের কুকুর সচরাচর প্রেমও করে না, তবু ওরা দেখা হলেই তেড়ে ঝগড়া করতে যায় কেন?

কুকুর নিয়ে যারা বেড়াতে বেরোয়, সাধারণত তাদের হাতে একটা ছোট লাঠি থাকে। এদের দু জনেরই হাত শূন্য। কালো লোকটির বুকের বোতাম সব খোলা, গোরিলার মতন লোমশবুক। কিন্তু তার ঝকমকে দুই চোখের মাঝখানে টিকোলো নাক। সে অলিমপিকের খেলোয়াড়দের মতন সুপুরুষ।

মহিলাটি তার কুকুরের চেনটা ছেড়ে দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে সেই কালো রঙের কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাদা কুকুরের ওপর। প্রবল ঘেউ-ঘেউয়ের সঙ্গে উলটে-পালটে যাচ্ছে দুটিতে। লম্বা লোকটি কোনও বাধা দিল না। সে হাসছে। সে শিস দিয়ে বলল, মেক লাভ, নট ওয়ার!

সঙ্গে-সঙ্গে ঝনঝন করে খসে পড়ল একটা দোকানের সাইনবোর্ড।

লম্বা, ঢোলা জামা পরা পাঠানটি দৌড়োতে-দৌড়োতে ফিরে এসে থমকে গেল। সাইনবোর্ডটি তুলে নিল যত্ন করে। তাতে আইসক্রিম হাতে একটি বালিকার ছবি আঁকা। পাঠানটি লম্বা, লাল জিভ বার করে সেই বালিকার গালটা চেটে দিল, তারপর সাইনবোর্ডটা দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে সে ছুটল আবার।

কুকুরদুটি ঝগড়া থামিয়ে পরস্পরের নাক শুকছে।

লম্বা লোকটি মহিলাকে জিগ্যেস করল, হোয়াটস ইয়োর ফোন নাম্বার? সাপুড়েদের বাঁশি এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। ওরা কি এখনও সাপ ধরতে পারেনি?

নীল বেলুনটা মাঝ রাস্তায় দুলছে।

ডোরাকাটা জাঙ্গিয়া পরা একজন চীনেম্যান বেরিয়ে এল একটা বন্ধ রেস্তোরাঁ থেকে। অনেকখানি হাঁ করে সে মুখের মধ্যে আঙুল চালিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। তারপর বার করে আনল একটা সোনার দাঁত। সেটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে হাতেই রেখে দিল।

এবার সে একটা গান শুরু করল। মুখে সোনার দাঁত থাকলে যে গান গাওয়া যায় না, এই সহজ ব্যাপারটা এতদিন বুঝিনি।

পাশের গাড়ি বারান্দাটায় পাশাপাশি সাতজন লোক কলাগাছের মতন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। যদিও কলাগাছের উপুড় বা চিৎ কিছু হয় না, তবু এরকমটা মনে হয়। একটু দূরে লাঠিতে জড়ানো পতাকার মতন একজন স্ত্রীলোক। তার পাশ-ফেরা মুখখানিতে ঘাম মাখা, তাঁর ঠোঁটের হাসিতে একটু-একটু স্বপ্ন লেগে আছে।

সাইলেন্সার পাইপ ছাড়াই একটা গাড়ি প্রবল শব্দ করে চলে গেল। কিন্তু সেদিকে কেউ ভ্রূক্ষেপও করল না।

স্ত্রীলোকটির পাশে একজন রুখুদাড়িওয়ালা লোক উঠে বসে খড়ি দিয়ে মাটিতে অঙ্ক কষছে। আমি উঁকি দিয়ে দেখলুম, অঙ্ক নয়, ছক কাটা, সে জ্যোতিষের চর্চা করছে মন দিয়ে! তার হোমওয়ার্ক। একটা ছক শেষ করে সে আর একা ছক আঁকল। তার কাছেই দুটো ক্রাচ রাখা। লোকটির ডান পা, না বাঁ-পা, কোনটা জখম? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

যে চীনেম্যানটি সোনার দাঁত হাতে নিয়ে গান গাইতে শুরু করল, তার কি একটা চোখ পাথরের?

একটা তালাবন্ধ ঘরের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে।

একটা নয়, দুটো তালা, পেতলের।

মোষটা এই পর্যন্ত এসে গেছে। রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে গাঁ-গাঁ করে ডেকে উঠল দু-বার। ওকি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে? কেউ কি ওর শিং-এর সাদা রং ধুয়ে-মুছে দিতে পারে না; তা হলে ও জঙ্গলে ফিরে যেতে পারত।

সাদা ও কালো কুকুর দুটো পাশাপাশি যাচ্ছে। ওদের মালিকেরা কোথায় গেল? অন্যদিকে আর একজন গোলগাল লোকের সঙ্গে দুটি অ্যালসেশিয়ান, তারা এদের গ্রাহ্যই করছে না। গোলগাল লোকটির পাজামার ওপর ফতুয়া পরা। মাথায় একটাও চুল নেই। লোকটি মোষটাকে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে লুঃ-লুঃ করে উঠল। কিন্তু তার পোষা কুকুর তার প্ররোচনা উপেক্ষা করে সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে লাগল আপন মনে।

বেলুনটা কি উড়ে গেল একেবারে, আর দেখতে পাচ্ছি না! রঙিন পাউডারের মতন মিহি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টিতে গা ভেজে না। বাতাসের সঙ্গে খেলা করে।

দুটি বামন অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছে। আগে তাদের বালক মনে হয়েছিল। কিন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট, বেশ খর্ব মানুষ, তারা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে এ-ওর গায়ে। তাদের কোনও কথা শুনতে পাচ্ছি না। একজনের হাসির উত্তরে অন্য জন হেসে উঠছে আরও জোরে। ওদের হাসির একটা ভাষা আছে। সে ভাষা আমি বুঝি না। কিন্তু ওরা যেন একটা গোপন খুশির বন্যা তুলে দিয়েছে। এত আনন্দ কী থেকে পাচ্ছে ওরা!

সাপুড়েদের বাঁশির সুর ক্রমশই তীব্র হয়ে উঠছে। সাপ কোনওরকম সুর, গান, শব্দই নাকি শুনতে পায় না! ওদের এই বাঁশি বাজানো তাহলে সাপ ধরার জন্য নয়? ওরা এখানকার মানুষদের ওই বাঁশির সুর শুনিয়ে রোজ জাগায়!

আমি এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লুম। হঠাৎ কেন এসেছি এই রাস্তায়? শহরের শ্রেষ্ঠ অংশে। অথচ কিছুই চিনতে পারছিনা। দিনের বেলা এই রাস্তাটা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়, সেটাই কি এর সত্য রূপ? অথবা দিনের বেলাতেই খুব অবাস্তব, অদ্ভুত সেজে থাকে নাকি?

গাউন পরা মহিলাটি ও কালো পুরুষটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল? কুকুর দুটো খেলা করছে, কালো ও সাদা, সাদা আর কালো। ঠিক যেন দুটো ঢেউ।

মাথায় কী যেন একটা লাগতেই চমকে উঠলুম।

সেই নীল বেলুনটা। কখন নেমে এসেছে, আমার গালে আর চুলে আদর করছে। তা হলে এই বেলুনটার সঙ্গেই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল!

বেলুনটার গায়ে লেখা, ওয়েল কাম!

COMMENTS

My Blog List

Name

featured,64,Sad Story,1,slider,65,অন্যান্য,8,ইতিহাস,4,উপন্যাস,12,কবিতা,8,কলাম,4,গল্প,38,ছোট গল্প,15,জীবনী,7,পারিবারিক,6,প্রবন্ধ,9,প্রেম,14,বাস্তবতা,5,বিদ্রোহ,7,বিরহ,8,ভালবাসা,12,ভৌতিক,2,ভ্রমণ কাহিনী,5,ভ্রমন,1,রহস্য,8,রূপকথা,1,রোমান্টিক,5,শিশু সাহিত্য,3,সংকলন,4,সংগ্রহ,2,সংলাপ,2,সামাজিক,7,সাহিত্য,13,স্মৃতিকথা,1,হাস্যরস,1,হুমায়ূন আহমেদ,11,
ltr
item
Golpo Blog: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলীক নগরী"------ মধু'র ভূবণ ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প, "অলীক নগরী"------ মধু'র ভূবণ ।
bangla sera galpo, bangla upponnash, bangla poem, bangla novel, premer golpo, sera bani, love quate, top bangla poem, recent abrritti, best poettry,
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEidaDIQltf84upYG8D4XTP6wUZEEKtM3e-7pOT-YfUvlt39CH-52_beSF6ds5Hh3rJFmoAcZlBRiPVPiTDO5WNNCorUC0gyC4a93OkRljeYKRIVxPFd4DGbzrYQ5P-VTA-6XR0zwTCrykre/w640-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%2595+%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%2580+.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEidaDIQltf84upYG8D4XTP6wUZEEKtM3e-7pOT-YfUvlt39CH-52_beSF6ds5Hh3rJFmoAcZlBRiPVPiTDO5WNNCorUC0gyC4a93OkRljeYKRIVxPFd4DGbzrYQ5P-VTA-6XR0zwTCrykre/s72-w640-c-h360/%25E0%25A6%25AD%25E0%25A7%2582%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A3%252C+%25E0%25A6%2585%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2580%25E0%25A6%2595+%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%2597%25E0%25A6%25B0%25E0%25A7%2580+.jpg
Golpo Blog
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_62.html
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/2021/05/blog-post_62.html
true
3394482685536881275
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy