হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা-না-দেখা" পর্বঃ-০২ @Golpo Blog

SHARE:

হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা না দেখা- পর্বঃ-০২, @Golpo Blog, humayun ahmed er uponnash, humayun ahmed er vromon kahini dekha na dekha 02,

হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র

"দেখা-না-দেখা"  

পর্বঃ-০২ 

হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র,  "দেখা-না-দেখা- পর্বঃ-০২   @Golpo Blog

হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র,  "দেখা না দেখা- পর্বঃ-০২   @Golpo Blog
একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি। চার অক্ষরে নাম এমন এক দেশ, যে নামে শুনলেই বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের মানুষের চোখ চকচক করতে থাকে। হিন্টস দিচ্ছি-আ দিয়ে শুরু। শেষ অক্ষর কা।

হয়েছে–আমেরিকা।

এই দেশে যাবার জন্যে জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত হওয়া মানুষদের আতঙ্কে অধীর হয়ে আমেরিকান আম্বেসিতে বসে থাকতে দেখেছি। সঙ্গে দলিল দস্তাবেজ। বাড়ির দলিল, জমির দলিল, গাড়ির ব্লু বুক, ব্যাংকের কাগজ। তারা প্রমাণ করবেন যে, দেশে তাদের যথেষ্ট বিষয়-আশয় আছে। ভিজিট ভিসায় বেড়াতে গেলেও ফিরে আসবেন। আল্লাহর কসম ফিরে আসবেন।

ভিসা রিজেক্ট হওয়ায় ভিসা অফিসে জনৈক বৃদ্ধ শোকে হার্টফেল করে মারা গেছেন-এই খবর প্রথম আলো পত্রিকায় পড়েছি।

আমি একজনকে জানি যিনি দেশের সব মাজার জিয়ারত করে আজমির শরিফ যাচ্ছেন খাজা বাবার দোয়া নিতে। খাজা বাবার দোয়া পেলে ভিসা অফিসারের মন গলবে, তিনি স্বপ্নের দেশে যেতে পারবেন। ইউরোপ আমেরিকা যাবার ব্যাপারটা না-কি খাজা বাবা কন্ট্রোল করেন।

আমেরিকা নামক এই স্বপ্নের দেশে আমাকে দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী কাটাতে হয়েছে। ছয় বছরের বেশি। পিএইচডি করলাম। পিএইচডি শেষ করে Post Doc করলাম। দেশে ফেরার পরেও আরো চার-পাঁচবার যেতে হলো। আমেরিকা নিয়ে বেশ কয়েকটা বইও লিখলাম। হোটেল গ্রেভার ইন, যশোহা বৃক্ষের দেশে, মে ফ্লাওয়ার। শেষবার আমেরিকায় গেলাম নুহাশকে নিয়ে। পিতা-পুত্রের যুগলবন্দি ভ্রমণ। ফেরার পথে দু’জনই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। নুহাশ ক্রমাগত বমি করছে, গায়ে জ্বর। আমার বুকে ব্যথা। আমি আতঙ্কগ্রস্ত। বুকের এই ব্যথা মানে হার্টবিষয়ক জটিলতা নয়তো? যদি সেরকম কিছু হয়, দু’জনকেই প্লেন থেকে নামিয়ে দেবে। আমাকে ভর্তি করবে হাসপাতালে। নয় বছর বয়েসি নুহাশ তখন কী করবে?

দেশে ফিরে ঠিক করলাম, আর অতি দূরের দেশে আর যাব না। আমেরিকায় কখনো না।

তারপরেও ব্যাগ-সুটকেস গোছাতে হলো। আবার আমেরিকা। তবে এবার অন্য একজনের তল্পিবাহক হিসেবে। সেই অন্য একজনের নাম মেহের আফরোজ শাওন। সে চন্দ্রকথা ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছে। বলিউড অ্যাওয়ার্ড। জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার দেয়া হবে।

আমার জন্যেও কী কী পুরস্কার যেন আছে। পুরস্কার নেবার জন্যে আমেরিকায় যাবার মানুষ আমি না। আমি যাচ্ছি শাওনের জন্যে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, শাওনের নতুন দেশ দেখার আগ্রহ যেমন আছে, পুরষ্কার নেবার আগ্রহও আছে।

এখন বিদেশে পুরস্কার বিষয়ে কিছু বলি। বেশ কয়েক বছর ধরে এটা শুরু হয়েছে। লন্ডন, আমেরিকা এবং দুবাই-এ পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান হয়।

শ্রেষ্ঠ গায়ক

শ্রেষ্ঠ গায়িকা

শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী

শ্রেষ্ঠ নায়ক

শ্রেষ্ঠ নায়িকা

… …

অনেক ক্যাটাগরি। বড় হল ভাড়া করা হয়। টিকিট বিক্রি করা হয়। টিকিট বিক্রির টাকাতেই খরচ উঠে আসে। টিভি রাইট বিক্রি হয়, সেখান থেকে টাকা আসে। সবচে বেশি আছে স্পন্সরদের কাছ থেকে। স্পন্সরের ব্যাপারটা খোলাসা করি। মনে করা যাক, আপনি একজন জনপ্রিয় নায়িকা। আপনাকে একটি পুরষ্কার (ভারী ক্রেস্ট, ঠিকমতো ধরতে হবে। হাত ফসকে পায়ে পড়লে জখম হবার সমূহ সম্ভাবনা) দেয়া হবে। যিনি পুরষ্কার হাতে তুলে দেবেন তিনিই স্পন্সর। তিনি পুরস্কার দেবার সময় হাসিমুখে আপনার সঙ্গে ছবি তুলবেন। আপনার বিষয়ে এবং নিজের বিষয়ে দুটি কথা দশটি কথাতে গড়াবে। পুরো সময়টাতে বিনয়ী ভঙ্গি করে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

রাত নটার দিকে আমি এবং শাওন পৌঁছলাম নিউ ইয়র্কের হোটেল রেডিসনে। পুরষ্কার কমিটি আমাদেরকে সেখানেই রাখার ব্যবস্থা করেছেন। হোটেল লবিতে পৌঁছে মোটামুটি বেকায়দা অবস্থায় পড়লাম। শিল্পীরা চারদিকে ঘুরঘুর করছেন। তাদের কারোর সঙ্গেই আমার তেমন পরিচয় নেই। মহিলা শিল্পীরা সবাই সঙ্গে তাদের গার্জেন নিয়ে এসেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মা, তারা সিরিয়াস সাজ দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসে টকটকে লাল করে মহানন্দে ঘুরছেন। তাদের আনন্দ চোখে পড়ার মতো। শিল্পী কন্যাদের কারণে আমেরিকা ভ্রমণ বিনে পয়সায় হচ্ছে। আনন্দিত হবারই কথা। এমন গুণী মেয়ে পেটে ধরা সহজ কর্ম না। এই ক্যাটাগরির এক মা আবার আমাকে চিনে ফেলে কাছে এসে জানতে চাইলেন–শিল্পী যারা এসেছেন তাদের জন্যে ডেইলি কোনো অ্যালাউন্স আছে কিনা। আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, এই বিষয়টি আমি জানি না। তিনি বললেন, থাকা উচিত। তিনি এর আগে মেয়ের সঙ্গে লন্ডনে পুরস্কার নিতে গেছেন, সেখানে মেয়েকে হাতখরচ দেয়া হয়েছে।

আমি বললাম, ও আচ্ছ।

ভদ্রমহিলা বললেন, বুঝলেন হুমায়ূন ভাই, নিজ থেকে চেয়ে নিতে হবে। অনুষ্ঠানের আগেই নিতে হবে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে আয়োজকরা আপনাকে চিনতেই পারবে না।

আমি আবারো বললাম, ও আচ্ছা।

ভদ্রমহিলা এই পর্যায়ে নতুন কাউকে আবিষ্কার করে তার দিকে ছুটে গেলেন। সম্ভবত তিনি আয়োজকদের কেউ।

অনেক রাতে আমাদের জন্যে ঘরের ব্যবস্থা হলো। জানানো হলো, গণখাবারের ব্যবস্থা আছে। কুপন দেখিয়ে খেতে হবে। কোনো এক প্রতিষ্ঠান খাবার স্পন্সর করেছে। কোথায় গিয়ে খাব, কুপনই বা কোথায় পাব, কিছুই জানি না। শাওন বলল, চল বাইরে চলে যাই। ম্যাকডোনাল্ডের হামবার্গার খেয়ে আসি। আমি খুব উৎসাহ বোধ করছি না। প্রথমত, রাত অনেক হয়ে গেছে-ম্যাকডোনাল্ড খুঁজে বের করা সমস্যা হবে। দ্বিতীয়ত, নিউ ইয়র্ক খুব নিরাপদ শহরও নয়।

আমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন ব্যান্ড তারকা জেমস। নিজেই খাবার এনে দিলেন। আর কিছু লাগবে কি-না অতি বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে বললাম, আপনার মা নিয়ে গাওয়া গানটি শুনেছি। মা নিয়ে সুন্দর গান করলেন, শাশুড়িকে নিয়ে গান নেই কেন? প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, শাশুড়িরা জামাইকে মায়ের চেয়েও বেশি আদর করে।

আমার কথা শুনে আঁকড়া চুলের জেমস কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎই হোটেল কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলেন। এমন প্রাণময় হাসি আমি অনেক দিন শুনি নি।
হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা না দেখা- পর্বঃ-০১
হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা না দেখা- শেষ পর্ব
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি জমকালো। লোকে লোকারণ্য। সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আয়োজকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। উত্তেজনার মূল কারণ, একজন ভারতীয় শিল্পী রাণী মুখাজি (ছায়াছবি ব্ল্যাক খ্যাত) দয়া করে পুরস্কার নিতে রাজি হয়েছেন। তিনি না কি যে কোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারেন। শুধু পুরস্কার হাতে তুলে নেবেন–এই কারণে তাকে বিপুল অঙ্কের ডলার দিতে হচ্ছে। এই নিয়েও আয়োজকদের দুশ্চিন্তা নেই। কারণ স্পন্সরদের মধ্যে ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে এই বিশেষ পুরস্কারটি স্পন্সর করা নিয়ে। ডলার কোনো সমস্যা না, রাণী মুখার্জির হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার দুর্লভ সম্মান পাওয়াটাই সমস্যা।

রাণী মুখাজি এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে বডিগার্ড। বাংলাদেশের অনেক শিল্পী এবং শিল্পীর মায়েরা আধপাগল হয়ে গেলেন। তাদের আহ্লাদী দেখে আমি দূর থেকে লজ্জায় মরে গেলাম। একবার মনে হলো, জাতিগতভাবেই কি আমরা হীনমন্য? কবে আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাস ফিরে পাব? রাণী মুখার্জিকে নিয়ে আহ্লাদীর একটা উদাহরণ দেই। আমাদের দেশের একজন অভিনেত্রী ছুটে গেলেন। গদগদ ভঙ্গিতে ইংরেজি এবং হিন্দি মিশিয়ে বললেন, আমি বিশ্বাস করছি আমি আপনাকে চোখের সামনে দেখছি। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই।

রাণী মুখার্জি : Please no. You can take picture.

বাংলাদেশী অভিনেত্রী : আমি কোনো কথা শুনব না। আমি আপনাকে ছুঁয়ে দেখবই।

রাণী মুখার্জি : Don’t touch me. Take picture,

বাংলাদেশী অভিনেত্রী : আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক না করলে আমি মরেই যাব।

রাণী মুখার্জি নিতান্ত অনিচ্ছায় এবং বিরক্তিতে হাত বাড়ালেন। বাংলাদেশের নামি অভিনেত্রী সেই হাত কচলাতে লাগলেন।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম জীবনে কখনো বিদেশে কোনো পুরষ্কার নিতে যাব না। এই জাতীয় দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার কোনো সাধ আমার নেই।

বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যেমন হীনমন্যতার ব্যাপার আছে, লেখকদের মধ্যেও আছে। তার একটি গল্প করি।

বাংলাদেশে জনৈক লেখক (নাম বলতে চাচ্ছি না) গিয়েছেন কোলকাতায়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। বাড়ি খুঁজে বের করে অনেকক্ষণ কলিংবেল টেপাটেপি করলেন। তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যজিৎ রায় নিজেই দরজা খুললেন। তবে পুরোপুরি খুললেন না। প্রবেশপথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। লেখক বৈঠকখানায় ঢুকতে পারছেন না। লেখক বললেন, আমার নাম …. আমি বাংলাদেশের একজন লেখক। নানান বিষয়ে বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে আমার প্রচুর বই প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে।

সত্যজিৎ : ও আচ্ছা।

লেখক : আমি আপনার ঠাকুরদা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর উপর বিশাল একটি বই লিখেছি।

সত্যজিৎ : ও আচ্ছা।

লেখক : আমি আপনার বাবা সুকুমার রায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা বই লিখেছি।

সত্যজিৎ: হুঁ।

লেখক : আমি আপনার উপরও একটি বই লিখেছি।

সত্যজিৎ : ধন্যবাদ।

লেখক : আপনার উপর লেখা বইটি আমি নিজের হাতে আপনাকে দিতে এসেছি।

সত্যজিৎ : আমার বাড়িটা ছোট। এত বই রাখার জায়গা আমার নেই। কিছু মনে করবেন না।

সত্যজিৎ রায় ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি এই গল্পটি অনেকের কাছে শুনেছি। সর্বশেষ শুনেছি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সাজ্জাদ শরীফের কাছে। যারা বাংলাদেশের ঐ লেখকের নাম জানতে আগ্রহী, তারা সাজ্জাদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

স্থান : হোটেল রেডিসনের ঘর।

সময় : সকাল দশটা।

হোটেলের রুম সার্ভিসকে টেলিফোন করেছি নাশতা দিয়ে যাবার জন্যে। নিজের টাকা খরচ করে খাব, আয়োজকদের উপর ভরসা করব না। রুম সার্ভিস থেকে আমাকে জানানো হলো, বাংলাদেশের গেস্টদের যে সব ঘর দেয়া হয়েছে সেখানে রুম সার্ভিস নেই।

ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। নাশতার কুপনও নেই। জেমসকেও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না যে তার কাছে সাহায্য চাইব। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেউ যেন অতি সাবধানে দু’বার বেল টিপেই চুপ করে গেল। আর সাড়াশব্দ নেই। আমি দরজা খুলে হতভম্ব। হাসি হাসি মুখে তিন মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। একজন ‘অন্যদিন’ পত্রিকার সম্পাদক মাজহার। সে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। আরেকজন অভিনেতা স্বাধীন, সে এসেছে লন্ডন থেকে। তৃতীয়জন এসেছে কানাডা থেকে, ‘অন্যদিন’-এর প্রধান সম্পাদক মাসুম। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। তারা তিনজন যুক্তি করে আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে একই সময় উপস্থিত হয়েছে শুধুমাত্র আমাকে এবং শাওনকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে।

আমরা সারপ্রাইড হলাম, আনন্দিত হলাম, উল্লসিত হলাম। আমার জীবনে আনন্দময় সঞ্চয়ের মধ্যে এটি একটি। তারা অতি দ্রুত রেন্ট-এ-কার থেকে বিশাল এক গাড়ি ভাড়া করে ফেলল। যতদিন আমেরিকায় থাকব ততদিন এই গাড়ি আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমরা যেখানেই ইচ্ছা সেখানে যাব।

কোথায় যাওয়া যায়?

আমেরিকায় মুগ্ধ হয়ে দেখার জায়গার তো কোন অভাব নেই। পর্বত দেখতে হলে আছে Rocky mountain, জনডেনভারের বিখ্যাত গান Rocky mountain high, সমুদ্র দেখতে হলে ক্যালিফোর্নিয়া। জঙ্গল দেখতে হলে মন্টানার রিজার্ভ ফরেস্ট, ন্যাশনাল পার্ক। গিরিখাদ দেখতে হলে-গ্রান্ড কেনিয়ন। যে গ্রান্ড কেনিয়ন দেখে লেখক মার্ক টুয়েন বলেছিলেন, যে ঈশ্বর বিশ্বাস করে না সে গ্রান্ড কেনিয়ন দেখলে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে বাধ্য।

প্রকৃতির বিচিত্র খেলা দেখতে উৎসাহী? তার জন্যেও আমেরিকা। আছে ওল্ড ফেইথফুল। ঘড়ির কাটার নিয়মে বিপুল জলরাশি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উঠে আসে আকাশে। আছে যশোহা বৃক্ষ নামের অদ্ভূত বৃক্ষের বন। দেখলে মনে হবে অন্য কোনো গ্রহে চলে এসেছি। আছে ক্রিস্টাল কেভস। মাটির গভীরে বর্ণাঢ্য ক্রিস্টালের গুহা। দেখলে মনে হবে হীরকখণ্ড দিয়ে সাজানো। আছে প্যাট্রিফায়েড ফরেস্ট। পুরো জঙ্গল অতি বিচিত্র কারণে পাথর হয়ে গেছে। যে জঙ্গলে ঢুকলেই রূপকথার জাদুকরদের কথা মনে হয়।

কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, কী কী দেখা হবে তা নিয়ে পুরো একদিন গবেষণার পর আমরা রওনা হলাম আটলান্টিক সিটিতে। শাওনের ধারণা হলো নিশ্চয় অপূর্ব কিছু দেখতে যাচ্ছি। সে যতই জানতে চায় আটলান্টিক সিটিতে কী আছে আমি ততই গা মুচড়ামুচড়ি করি। ভেঙে বলি না। কারণ আটলান্টিক সিটি হলো গরিবের লাস ভেগাস। জুয়া খেলার ব্যবস্থা ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। একজন বঙ্গললনাকে তো বলা যায় না, আমরা যাচ্ছি জুয়া খেলতে। বঙ্গললনারা সবাই ‘দেবদাস’ পড়েছেন। মদ এবং জুয়া কী সর্বনাশ করে তা তারা জানেন।

পবিত্র কোরান শরীফে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে–’দুইয়ের মধ্যেই মানুষের জন্যে কিঞ্চিৎ উপকার আছে। 
তবে উপকারের চেয়ে ওদের দোষই বেশি।’ (সূরা বাকারা, ২-২১৯)।

সূরা বাকারার এই আয়াতটির অনুবাদ একেক জায়গা একেক রকম দেখি। নিজে আরবি জানি না বলে আসল অনুবাদ কী হবে বুঝতে পারছি না। আরবি জানা কোনো পাঠক কি এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য করবেন?

অনেক অনুবাদে আছে—’উপকারের চেয়ে ওদের অপকারই বেশি। এর পরেও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’

আবার অনেক অনুবাদে ‘এরপরেও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ অংশটি নেই। এই মুহূর্তে আমার হাতে আছে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কোরান শরীফ সরল বঙ্গানুবাদ, সেখানে ‘এরপরেও কি তোমরা নিবৃত্ত হইবে না’ অংশটি নেই।


জুয়াতে যে কিঞ্চিৎ উপকার আছে তার প্রমাণ মাজহার আটলান্টিক সিটিতে পৌঁছামাত্র পেল। স্লট মেশিনে প্রথমবারই Jack pot, ট্রিপল সেভেন। একটা কোয়ার্টার ফেলে সে পেল সাত হাজার ইউএস ডলার। ঢাকা-নিউইয়র্ক যাওয়া আসার খরচ উঠে গেল।

কাছের কাউকে জ্যাকপট পেতে আমি কখনো দেখি নি। ব্যাপারটায় অত্যন্ত আনন্দ পেলাম। আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না, কারণ মাজহার আবারো একটি জ্যাকপট পেল। প্রিয়জনদের সামান্য উন্নতি সহ্য করা যায়। বেশি সহ্য করা যায় না। মানুষ হিংসুক প্রাণী।

আমরা কেউ মাজহারের সঙ্গে কথা বলি না। সে চৌদ্দ হাজার ডলারের মালিক। বাংলাদেশি টাকায় ১২ লাখ টাকা। মেশিনের হ্যান্ডেল কয়েকবার টেনে বার লক্ষ টাকা যে পায় তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা অর্থহীন। আমরা যে মাজহারকে পাত্তা দিচ্ছি না সে এটা বুঝতেও পারছে না। নিজের মনে মহানন্দে নানাবিধ জুয়া খেলে যাচ্ছে-রুনেট, ফ্লাশ, স্পেনিশ টুয়েন্টি ওয়ান। জুয়া খেলার টাকার অভাব এখন আর তার নেই। বড় বড় দান ধরে সে আশেপাশের সবাইকে চমকে দিচ্ছে। আরবের শেখ গুষ্টি পর্যন্ত চমকিত।

এক ফাঁকে বলে নেই–ধর্মপ্রাণ (?) এবং ধনবান আরবদের একটি বড় অংশ আমেরিকায় আসেন জুয়া খেলতে। রুনেটের টেবিলে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে থাকেন। তাঁদের হাতে থেকে তসবি। সামনের গ্লাসে অতি দামি হুইস্কি। জুয়া এবং মদ্যপানের মধ্যেও তারা মহান আল্লাহকে ভুলেন না। তসবি টানতে থাকেন।

সূরা বাকারার আয়াত মাজহারের ক্ষেত্রে খেটে গেল। সন্ধ্যা নাগাদ তার সব জেতা টাকা চলে গেল। নিজের পকেট থেকেও গেল। কত গেল এটা সে বলে না। প্রশ্ন করলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সে বলল, এটা শয়তানের আখড়া। শয়তানের আখড়ায় আর এক মুহূর্ত থাকা ঠিক না। আমাদের এক্ষুনি অন্য কোথাও চলে যাওয়া প্রয়োজন। আমেরিকায় এত কিছু আছে দেখার, সেইসব বাদ দিয়ে ক্যাসিনো ভ্রমণ, ছিঃ!

মাজহারের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আটলান্টিক সিটি ছেড়ে আমরা রওনা হলাম ওয়াশিংটন ডিসির দিকে। ওয়াশিংটন ডিসি হলো মিউজিয়াম নগরী। কতকিছু আছে দেখার। এক স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামেই তো দু’দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। সেখানে আছে রাইট ব্রাদার্সের বানানো প্রথম বিমান। যে লুনার মডিউল চাঁদে নেমেছিল, সেই লুনার মডিউল। চাঁদের পাথর। যে পাথর হাত রেখে ছবি তোলা যায়।

আমাদের গাড়ি হাইওয়ে দিয়ে ছুটছে। ঘণ্টা দুই পার হয়েছে, হঠাৎ আমাদের মনে হলো গভীর রাতে আমরা ওয়াশিংটন পৌঁছব। হোটেল ঠিক করা নেই। সমস্যা হতে পারে। সঙ্গে মেয়েছেলে (শাওন) আছে। মেয়েছেলে না থাকলে অন্য কথা। তারচে’ বরং আটলান্টিক সিটিতে যাই। সেখানে হোটেলে আরামে রাত কাটিয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

আমরা আটলান্টিক সিটিতে পৌঁছেই ক্যাসিনোতে ঢুকে গেলাম। মাজহার আরো হারল।

পরদিন শাওন খুব হৈচৈ শুরু করল। মেয়েদের বেশির ভাগ হৈচৈ যুক্তিহীন হয়। তারটায় যুক্তি আছে। সে বলল, আমি জীবনে প্রথমবার আমেরিকায় এসেছি। আবার আসতে পারব কিনা তার নেই ঠিক। আমি কি স্লট মেশিনের জঙ্গল দেখে বেড়াব? আর কিছুই দেখব না?

তাকে শান্ত করার জন্যে পরদিন রওনা হলাম ফিলাডেলফিয়া। ফিলাডেলফিয়াতে ক্রিস্টাল কেইভ দেখব। কিছু ভুতুড়ে বাড়ি আছে (Haunted house), সে সব দেখব। ভূতরা দর্শনার্থীদের নানাভাবে বিরক্ত করে। কিছু কিছু ভূত আবার দৃশ্যমান হয়। আমার অনেক দিনের ভূত দেখার শখ। তার জন্যে ফিলাডেলফিয়া ভালো শহর।

বিকেলে এক রেস্টুরেন্টে চা খাবার পর মনে হলো-টিকিট কেটে ভূত দেখা খুবই হাস্যকর ব্যাপার। ভূত ছাড়া এই শহরে দেখারও কিছু নেই। Crystal cave-ও তেমন কিছু না। ঝলমলে কিছু ডলোমাইট। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি কোথায় যাওয়া যায়।

শাওন বলল, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্যে সেই আটলান্টিক সিটিতেই যেতে হবে? এখানে মাথা ঠাণ্ডা হবে না?

আমি বললাম, অবশ্যই হবে। তবে এখানে হোটেলের ভাড়া অনেক বেশি। আটলান্টিক সিটিতে সস্তা।

আবারো গাড়ি চলল আটলান্টিক সিটির দিকে। সফরসঙ্গীরা ফিলাডেলফিয়াতে এসে মুষড়ে পড়েছিল। আবারো তাদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেল। স্বাধীন অতি আনন্দের সঙ্গে বলল, হুমায়ুন ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মজাই অন্যরকম।

প্রিয় পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা যদি মনে করেন আমরা আটলান্টিক সিটির জুয়াঘর ছাড়া আমেরিকায় আর কিছুই দেখি নি তাহলে ভুল করবেন।

আর কিছু না দেখলেও আমরা নায়েগ্রা জলপ্রপাত নামক বস্তুটি দেখেছি। প্রমাণস্বরূপ ছবি দিয়ে দিলাম। আমরা যেন পাহাড় ভেঙে নামা বিপুল জলধারা ভালোমতো দেখতে পারি, প্রকৃতির এই মহাবিস্ময় পুরোপুরি উপভোগ করতে পারি, তার জন্যে দু’দিন দু’রাত নায়েগ্ৰাতেই পড়েছিলাম। এখানে অবশ্যি রাজনীতিবিদদের ভাষায় একটি সূক্ষ্ম কারচুপি আছে। নায়েগ্রাতে ক্যাসিনো আছে। এদের জুয়া খেলার ব্যবস্থাও অতি উত্তম।



COMMENTS

My Blog List

Name

featured,64,Sad Story,1,slider,65,অন্যান্য,8,ইতিহাস,4,উপন্যাস,12,কবিতা,8,কলাম,4,গল্প,38,ছোট গল্প,15,জীবনী,7,পারিবারিক,6,প্রবন্ধ,9,প্রেম,14,বাস্তবতা,5,বিদ্রোহ,7,বিরহ,8,ভালবাসা,12,ভৌতিক,2,ভ্রমণ কাহিনী,5,ভ্রমন,1,রহস্য,8,রূপকথা,1,রোমান্টিক,5,শিশু সাহিত্য,3,সংকলন,4,সংগ্রহ,2,সংলাপ,2,সামাজিক,7,সাহিত্য,13,স্মৃতিকথা,1,হাস্যরস,1,হুমায়ূন আহমেদ,11,
ltr
item
Golpo Blog: হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা-না-দেখা" পর্বঃ-০২ @Golpo Blog
হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা-না-দেখা" পর্বঃ-০২ @Golpo Blog
হুমায়ুন আহমেদ এর ভ্রমণ সমগ্র, "দেখা না দেখা- পর্বঃ-০২, @Golpo Blog, humayun ahmed er uponnash, humayun ahmed er vromon kahini dekha na dekha 02,
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhil8J18-brbthaK8TENpslr6JhQnRdnImm90-OEq0_S1_1cdFYqfxzVZ-2q112IXsrbNBvYhvL31ZVnhr6K4TFoH79iXO1wlenGJoDWz1_DqmsR_z_EzwA9iic0Viv2Xr4meEj4QAiQGm92gYqu4lPII7HQ_93eNp7fHDirubvOoZJ34D1gLmHwp6pWQ/w640-h358/%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%20%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A6%20%E0%A6%8F%E0%A6%B0%20%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%A3%20%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0,%20%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%20%E0%A6%A8%E0%A6%BE%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%20%20%20@Golpo%20Blog%20.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhil8J18-brbthaK8TENpslr6JhQnRdnImm90-OEq0_S1_1cdFYqfxzVZ-2q112IXsrbNBvYhvL31ZVnhr6K4TFoH79iXO1wlenGJoDWz1_DqmsR_z_EzwA9iic0Viv2Xr4meEj4QAiQGm92gYqu4lPII7HQ_93eNp7fHDirubvOoZJ34D1gLmHwp6pWQ/s72-w640-c-h358/%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%20%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%A6%20%E0%A6%8F%E0%A6%B0%20%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%A3%20%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0,%20%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%20%E0%A6%A8%E0%A6%BE%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%BE%20%20%20@Golpo%20Blog%20.jpg
Golpo Blog
https://golpoblog.mrmodhu.com/2023/01/dekhanadekha02.html
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/
https://golpoblog.mrmodhu.com/2023/01/dekhanadekha02.html
true
3394482685536881275
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy